ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রত্যাবাসনে বাধা- ষড়যন্ত্রী রোহিঙ্গা নেতাদের গা-ঢাকা

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৫ আগস্ট ২০১৯

প্রত্যাবাসনে বাধা- ষড়যন্ত্রী রোহিঙ্গা নেতাদের গা-ঢাকা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি না হওয়ার পেছনে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। এজন্য রোহিঙ্গাদের উস্কানিদাতা দেশী-বিদেশী কিছু এনজিও এবং রোহিঙ্গা নেতাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। গোয়েন্দা সংস্থা ওইসব ঘড়যন্ত্রকারীর তালিকা তৈরি করতে মাঠে নেমে সংগ্রহ করছে তথ্য। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ মহল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় জনগণ সবাই পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন যে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হবে। গত বছরের ১৫ নবেম্বর নির্ধারিত তারিখে প্রত্যাবাসনে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। প্রায় ৯ মাস পর ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দিন তারিখ ঠিক করা হয়। দ্বিতীয়বারও সরকারের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে উঠেপড়ে লাগে অর্ধ শতাধিক এনজিও এবং দুই’শ রোহিঙ্গা নেতা। তারা আশ্রয় শিবিরে বিভিন্নভাবে প্রচার এবং প্রসার ঘটিয়েছে যে মিয়ানমারে এখন যে অবস্থা তা নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় না। নির্যাতিত রোহিঙ্গারা ফের নির্যাতনের শিকার হবে ইত্যাদি। এসব গুজব ও অপপ্রচারে আতঙ্ক ছড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। প্রত্যাবাসন বাতিলে বিপুল টাকা খরচ ও ব্যবহার করা হয়েছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী নেতারা ১৮ আগস্ট থেকে চারদিন ধরে বিভিন্ন শিবিরে সরেজমিনে গিয়ে, বাহক মারফত নতুবা মুঠোফোনে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনে রাজি না হতে উস্কানি দিয়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের। শিবিরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারাও তাদের নেতাদের (আরএসও জঙ্গী) কথামতো মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি তারা। প্রশাসন এসব বিষয় জানতে পেরে তদন্ত শুরু করায় পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওপারের পক্ষ থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া ৩ হাজার ৫৪০ জনের তালিকার একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে স্থানীয়রা। তারা বলেন, শিবিরে থাকা অবস্থায় দাবি জানিয়ে রোহিঙ্গাদের এমন অনড় অবস্থানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ক্যাম্পে সেবা কার্যক্রম চালানো সেই বিবৃতিদাতা অর্ধ শতাধিক উন্নয়ন সংস্থা। প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত নেতিবাচক প্রচারের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নানামুখী দাবি-দাওয়া উত্থাপনে উৎসাহী করছে তারা। যার ফলে প্রত্যাবাসনের সামান্য সম্ভাবনাও অঙ্কুরে নষ্ট হচ্ছে। তাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর আগে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জরুরী কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে এনজিওব্যুরোর অনুমতি ব্যতিরেকে অর্ধ শতাধিক এনজিও, সংস্থা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গা সেবার নামে কাজ করছে আশ্রয় শিবিরে। বিদেশী ফান্ড এনে তারা রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করার অনুমতিপ্রাপ্ত কিছু এনজিওর অধীনে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এতে রয়েছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের একাধিক সংস্থা। আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে ওসব রোহিঙ্গা নেতাদের সংস্থার নামে বিদেশী ফান্ড আসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে সন্দেহে প্রত্যাবাসনে ষড়যন্ত্র করে চলেছে তারা। অভিযোগ রয়েছে সরকার দলীয় চট্টগ্রামের একজন সংসদ সদস্যের পরিচালনাধীন একটি ফাউন্ডেশনের নাম ভাঙ্গিয়ে কয়েকজন পুরনো রোহিঙ্গা নেতা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশী ফান্ড এনে থাকে। ওসব ফান্ড (ত্রাণ) থেকে একটি অংশ (কমিশন) জমা করা হয় এনজিওব্যুরো অনুমোদিত ওই ফাউন্ডেশনের নামে। আরেকটি অংশ রোহিঙ্গা সেবার নামে বণ্টন দেখিয়ে ফটোসেশন ও ভিডিও করে পাঠানো হয় বিদেশে। সিংহভাগ ত্রাণ আত্মসাত করে কোটিপতি বনে গেছে রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন হলে বিদেশী ওই ফান্ড আরএসও জঙ্গীদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ধারণায় চিহ্নিত এনজিওগুলোর মাধ্যমে আশ্রিতদের উস্কানি দিয়ে চলেছে। উখিয়া টেকনাফে ৩২টি আশ্রয় শিবিরে অন্তত ১৫০ জন মাঝি কয়েকটি এনজিও’র কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখছে। তথ্য পাওয়া গেছে, অন্তত দুই শতাধিক বিদ্রোহী রোহিঙ্গার মধ্যে ২৫জন প্রথম সারির রোহিঙ্গা নেতা রয়েছে। তারা বাংলাদেশী দাবিদার। তাদের কাছে রয়েছে জাতীয় সনদ। বৈধ কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে পাসপোর্টও বানিয়েছে ওই জঙ্গী রোহিঙ্গারা। তাদের সঙ্গে রয়েছে বিদেশী একাধিক জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সখ্যতা। এদের কয়েকজন জঙ্গীর উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অফিস রয়েছে। তারা বিদেশে গিয়ে মোটা অঙ্কের ফান্ড নিয়ে আসে রোহিঙ্গাদের জন্য। পরবর্তীতে একটি অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে থাকে। ওসব রোহিঙ্গা জঙ্গীদের পাসপোর্ট জব্দ করার জন্য দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। রোহিঙ্গা নেতাদের গা ঢাকা ॥ পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের মধ্যে যারা এদেশের জাতীয় সনদ হাতিয়ে নিয়েছে, আশ্রয় ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়ার উস্কানি দিয়েছে তাদের অনেকে গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছে। এদের কেউ কেউ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সোর্স বলে দাবি করলেও বর্তমানে তাদেরও দেখা মিলছে না বলে আশ্রয় শিবির এলাকার একাধিক সূত্রে জানা গেছে। প্রত্যাবাসনবিরোধী মিয়ানমারের নাগরিক পুরনো রোহিঙ্গা নেতা ওই জঙ্গীরা হচ্ছে- মৌলবি মোঃ ইদ্রিছ, মৌলবি ছালামত উল্লাহ ওরফে শায়খ ছালামত, মৌলবি আবদুর রহিম, মৌলবি আয়াছ, মৌলবি মোয়াজ্জেম হোছাইন সাঈফি, সেলিম উল্লাহ, মৌলবি ইয়াছিন, হাফেজ জাবের, হাফেজ মোঃ হাসিম, মৌলবি আবু নফর, মৌলবি ওসমান নেজামী, মৌলবি ইয়াহিয়া, মোঃ জুবায়ের, মৌলবি শামসু, মৌলবি আবদুল হামিদ, রুহুল আমিন, মৌলবি শফিকুর রহমান, হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, মৌলবি মোঃ আনিস, হাফেজ জুবায়ের, আবু সিদ্দিক আরমান ও আবদুল হাকিম ডাকাত। প্রত্যাবাসনে ষড়যন্ত্রকারী এনজিও ॥ মিয়ানমার সঙ্কটের অবনতিতে সতর্ক করে সেভ দ্য চিলড্রেন এর মাধ্যমে যে এনজিওগুলো বিবৃতি দিয়েছে, যারা নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের জড়িত করার আহ্বান জানিয়েছে এবং প্রত্যাবাসন স্থগিত করতে সরকারের কাছে চার সুপারিশ পেশ করেছে, ওইসব এনজিও রোহিঙ্গারা তাড়াতাড়ি ফেরত যাক, এটা চাইছেনা। দেশী -বিদেশী অর্ধ শতাধিক এনজিও প্রত্যাবাসন স্থগিত করে সরকারের কাছে যে চারটি সুপারিশ উত্থাপন করেছে, ওসব সুপারিশ রোহিঙ্গাদের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ওইসব রোহিঙ্গা নেতা এবং এনজিওগুলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছে দাবিদাওয়া সম্বলিত লিফলেট সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, জীবিকা নির্বাহ ও সুরক্ষায় সুযোগ নিশ্চিত করা এবং মধ্যম-দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বের করার দাবি জানিয়ে যেসব এনজিও বিবৃতি দিয়েছে, মূলত তারাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিরোধিতা করে চলেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন এনজিওদের একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে তাদের কিছু নেতার বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশী-বিদেশী কিছু এনজিও ওদের (রোহিঙ্গা) ইন্ধন যোগাচ্ছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার কিছু এনজিওকে নজরদারির আওতায় আনার পাশাপাশি কিছু রোহিঙ্গা নেতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে। তারা প্ররোচনা দিচ্ছে যে, তাদের না যাওয়াা উচিত। আমরা তাদের ওপর একটু নজরদারি করব। কারণ তারা টার্মস এ্যান্ড কন্ডিশন ভঙ্গ করছে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
×