ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে জন্মাষ্টমীর বর্ণাঢ্য মিছিল

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৪ আগস্ট ২০১৯

  রাজধানীতে জন্মাষ্টমীর  বর্ণাঢ্য  মিছিল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিপুল ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে শুক্রবার সারাদেশে পালিত হয়েছে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি, শুভ জন্মাষ্টমী। ঢাকাসহ সারাদেশেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায় বের করে বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল। শান্তি, কল্যাণ ও মানবতাবোধের শক্তিতে প্রাণিত হয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, অসত্য ও অন্যায়ের অবসান সম্ভব- এই পূর্ণতিথিতে সেই শুভকামনাই ছিল দিবসটির মূলকথা। রাজধানী ঢাকায় ৪০৬ বছরে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা সুবিশাল জন্মাষ্টমীর মিছিলপূর্ব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে সাম্প্রাদায়িক অপশক্তির বিষবৃক্ষকে উৎপাটনের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আপনাদের (হিন্দু সম্প্রদায়) শত্রু যারা, তারা বাংলাদেশের শত্রু। এই শত্রুরা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষবৃক্ষকে উৎপাটনে সবার প্রতি আমার আহ্বান, আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিরোধ করি। বৃষ্টিবিঘিœত অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের সনাতন ধর্মালম্বীদের উদ্দেশে করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মাইনরিটি (সংখ্যালঘু) বান্ধব সরকার। এ সরকার যতদিন আছে আপনাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই। আপনাদের দুর্গোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। অন্য উৎসবগুলোও শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এইদিক দিয়ে আপনারা নিরাপদ। অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরের মধ্য দিয়ে দু’দশের বিরাজমান অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাব উল্লেখ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন নতুন উচ্চতায় উন্নীত। আমাদের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের কোন টানাপোড়েন নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের বিরাজমান অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাব। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তবে সবার প্রতি অনুরোধ, আমাদের কোন আচারণে যেন কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না লাগে এ বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে দিনের শুরুতেই ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় শ্রী শ্রী গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী মঙ্গলাচারণ, নামকীর্তন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ, কৃষ্ণ পূজা, পদাবলী কীর্তন, দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা সভা, আলোচনা সভা ও ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শুক্রবার ছিল সরকারী ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়ের কল্যাণ কামনা করে পৃথক বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ নিবন্ধ। বেতার-টেলিভিশন ও বিভিন্ন সরকারী চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তবে দিবসটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী মিছিল। ঢাকায় প্রচন্ড বৃষ্টি এবং বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও এবারের জন্মাষ্টমী মিছিলে নেমেছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী লাখো মানুষের ঢল। নির্বিঘ্নে ও প্রাণখুলে হাজার হাজার পুণ্যার্থী মনোলোভা ও জৌলুসপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়গান গেয়েছেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুক্রবার থেকে স্বামীবাগ আশ্রমে শুরু হয়েছে। রাজধানীতে মনোলোভা জন্মাষ্টমী মিছিল ॥ ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল উপলক্ষে শুক্রবার বেলা ২টার আগ থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামে পলাশীর মোড়ে। জন্মাষ্টমী মিছিল বিকাল পৌনে চারটার দিকে শুরু হওয়ার আগেই হাজার হাজার পুণ্যার্থীদের স্রোতে পুরো এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে। জন্মাষ্টমীর মিছিলকে সামনে রেখে নজরকাড়া নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুর থেকেই শত শত পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেন পুরো এলাকা। কিন্তু আনন্দ-উৎসবে বাদসাধে মুষলধারে বৃষ্টি। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্যে দিয়ে মনোলোভা জন্মাষ্টমীর মিছিলটি শুরু হয়। বিকেল পৌনে চারটার দিকে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর পলাশীর মোড় থেকে জমকালো এই জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়। সর্বাগ্রে অশ্বারোহীর হাতে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা এবং পেছনে হাতি, ঘোড়া, গরুর গাড়ি, রথ, টমটম, বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও অসংখ্য ট্রাকের মিছিল নিয়ে শুরু হয় এই বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা যেন প্রাণখুলে ডাকলেন মহাবতার শ্রীকৃষ্ণকে। অনেকটা প্রাণখুলেই হাজারো নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধবনিতা অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। শুধু দেশেরই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আগাত কৃষ্ণভক্ত বিদেশীরাও নেচে-গেয়ে, সুদীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটেই অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। বিকেল পৌনে চারটার দিকে বৃষ্টির মধ্যেই ‘হলে কৃষ্ণ, হরে রাম’ ধ্বনীতে ঢাক, খোল, করতাল, শঙ্খ, উলুধ্বনীতে চারদিক মুখরিত করে তুলে ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল শুরু হয়। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যান্ডপার্টি, ঢোল, ঢাক ও লাউড স্পীকারের গান-বাজনার তালে তালে হাজার হাজার পুণ্যার্থী নেচে-গেয়ে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের করুণা চেয়ে তাঁর আবাহন সঙ্গীতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভার পর মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মিছিলের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি ওবায়দুল কাদের এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদারের সভাপতিত্বে সংক্ষিপ আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, বাংলাদেশ পূজা উদাযাপন কমিটির সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী, ঢাকা মহানগর পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট কিশোর রঞ্জন মন্ডল, রমেন মন্ডল প্রমুখ। এ সময় সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, সাবেক এমপি অধ্যাপিকা অপু উকিল, স্থানীয় কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ শোভাযাত্রায় অসংখ্য ট্রাকে, টমটমে, রথ ও ঘোড়া ও গরুর গাড়িতে ধর্মাবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকৃতি বহন করা হয়। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে চলা ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার ধ্বনি ছিল- ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বর্ণাঢ্য বেশ কয়েকটি মিছিলে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মুহূর্তটি স্মরণ করিয়ে দিতে ছোট ছোট শিশুকে কৃষ্ণের অবয়বে সাজিয়ে মাথায় নিয়ে মিছিলে অংশ নেন ভক্তরা। জন্মাষ্টমীর জমকালো এই শোভাযাত্রাটি ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশীর মোড় হয়ে জগন্নাথ হলো, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মোড়, প্রেসক্লাব, পল্টন, জিপিও, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, নবাবপুর রোড হয়ে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। দীর্ঘ এই মিছিলের কারণে ঢাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ পথে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেন এই দৃষ্টিনন্দন জন্মাষ্টমীর মিছিল। তবে কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
×