ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতে ঘাতক হারুনের জবানবন্দী

সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যার কথা স্বীকার

প্রকাশিত: ১০:২৫, ৯ জুলাই ২০১৯

 সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যার কথা স্বীকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরান ঢাকার ওয়ারীর বনগ্রামে স্কুল পড়ুয়া শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে (৭) ধর্ষণের পর হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে ঘাতক হারুন অর রশিদ। সোমবার দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক মোঃ আর্জুন আসামি হারুনকে আদালতে হাজির করেন। এ সময় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী রেকর্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী এই কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনসারী তার জবানবন্দী রেকর্ড করেন। বেলা ১টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়ে ৪টা ২৫ মিনিটে টানা তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট জবানবন্দী গ্রহণ শেষ করেন বিচারক। জবানবন্দী রেকর্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর হাকিম। আদালতে সংশ্লিষ্ট থানার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান। মামলার এজাহারে যা ছিল ॥ মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ৫ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে শিশু সায়মা খেলাধুলার নাম করে মনির হোসেনের পাশের ফ্ল্যাটে যায়। সায়মার বাবা মাগরিবের নামাজ শেষে ছেলে-মেয়ের জন্য নাস্তা কিনে বাসায় ফেরে এবং তার মাকে মেয়ের কথা জিজ্ঞসা করেন। তখন সায়মার মা জানান, পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী মনিরের বাসায় খেলতে গেছে। সন্ধ্যায় আনুমানিক ৭টার সময় সামিয়া বাড়িতে ফিরে না আসায় আমার স্ত্রী সানজিদা আক্তার মনিরের বাসায় খুঁজতে যায়। মনিরের বাসায় না পেয়ে আমার স্ত্রী ফেরত আসে। এরপর আমি আমার স্ত্রী ও বড় মেয়ে ফারজানা প্রতিবেশী মনির ও তার স্ত্রীসহ বিল্ডিংয়ে সমস্ত যায়গায় খুঁজতে থাকি। নিচতলা থেকে, আশেপাশের ফ্ল্যাটে না পেয়ে নবম তলায় খালি যায়গায় খুঁজতে যাই। নবম তলায় সব জায়গায় তালাবদ্ধ থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নবম তলায় উত্তর পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পাই, আমার মেয়ের পায়ের স্যান্ডেল দুটি পড়ে আছে। সেন্ডেল দেখে আমাদের সন্দেহ হলো ভেতরে রুমে খুঁজতে থাকি। এজাহারে আরও জানা যায়, খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ওই ফ্ল্যাটের কিচেন রুমে সিঙ্কের নিচে গলায় শক্ত করে পাটের রশি দিয়ে পেঁচানো, মুখে রক্তাক্ত এবং পরণের হাফপ্যান্ট সামনের দিকে ছেড়া, রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পান তিনি। এরপর আমরা থানায় পুলিশকে সংবাদ দিলে পুলিশ এসে আমার মেয়েকে সিঙ্কের নিচ থেকে বের করে। এরপর ওয়ারী থানার পুলিশ আমার মেয়ের লাশের সুরতহাল প্রস্তুত ও ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। আমাদের ধারণা আমার মেয়ে মনিরের বাসা থেকে বের হয় আমার ফ্লাটে আসার পথে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে কেউ নবম তলায় উত্তর পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটের উত্তর-পশ্চিমের কোন রুমে নিয়ে আমার মেয়েকে ধর্ষণ করে। এরপর সামিয়ার গলায় শক্ত করে পাটের রশি দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ৫ জুলাই রাত ৯টার দিকে পুরানো ঢাকার ওয়ারীর বনগ্রাম মসজিদ রোডের ১৬৯ নম্বর ভবনের ৯ তলার খালি ফ্ল্যাট থেকে সামিয়া আক্তার সায়মার (৭) মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় গত ৬ জুলাই দুপুরে সামিয়ার বাবা আব্দুস সালাম অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে ওয়ারী থানায় ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ করে একটি মামলা দায়ের করে। নিহত সায়মার বাবা আব্দুস সালাম নবাবপুরের একজন ব্যবসায়ী। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই ভবনে ফ্ল্যাট কেনার পর তিনি পরিবার নিয়ে সেখানে ওঠেন। নিহত সায়মা পুরানো ঢাকার ওয়ারীর সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী ছিল। ২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সামিয়া সবার ছোট ছিল। সে ওয়ারীর বনগ্রাম মসজিদ রোডের ১৬৯ নম্বর ৯ তলা ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় থাকত। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, শুক্রবার মাগরিবের নামাজের সময় সামিয়া নিখোঁজ হয়। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওই ভবনের ৯ তলার একটি ফাঁকা ফ্ল্যাটে শিশু সামিয়ার গলায় রশি পেঁচানো লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশ গিয়ে সেখানে থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঘটনার পর সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আশেপাশে আলমত সংগ্রহ করেন। শনিবার দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে শিশুটি সায়মার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার পর তার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে তার শরীরে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর তাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। সোহেল মাহমুদ জানান, ময়নাতদন্তে তার যৌনাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন, মুখে রক্ত ও আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁটে কামরের দাগ দেখা গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট হতে তার ‘হাই ভ্যাজাইনাল সয়াব’ জন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সকল নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। এসব প্রতিবেদন পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়া হবে। পরে ময়নাতদন্ত শেষে তার বাড়িতে নেয়ার পর বিকেলে সায়মার লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুলিশ জানায়, শনিবার সকালে শিশুর বাবা আব্দুস সালাম বাদী হয়ে ওয়ারী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন। ভবনের আশপাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করা হয়। পরে সন্দেহে কয়েকজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর ঘাতক হারুন উর রশীদকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়।
×