স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট সংলগ্ন রাস্তায় প্রায় ৪৫ মিনিট যাবত দাঁড়িয়ে আছে একটি সিএনজি অটোরিক্সা। এই সময়ের মধ্যে তিনজন যাত্রী এসেছে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সিএনজি চালক হয় বলেছেন ওই দিকে যাবেন না, অথবা তুলনামূলক ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া চেয়েছেন। এবার অন্য আরেক যাত্রী যেতে চাইলেন কল্যাণপুর, তবে তিনি মিটারে যে ভাড়া আসবে সে ভাড়াতেই যেতে চাচ্ছেন, কিন্তু চালক মিটারে যাবেন না। ভাড়া চাইলেন ৩০০ টাকা। সেই যাত্রীও ফিরে গেলেন। ফলে তখন পর্যন্ত কোন যাত্রী পেলেন না সেই সিএনজি চালক।
এবার আলাপ হলো এই সিএনজি চালকের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি জানালেন; তার নাম আব্দুল মজিদ। পেশাদার সিএনজি চালক তিনি। প্রায় ৭ বছর ধরে ঢাকায় সিএনজি চালাচ্ছেন।
আব্দুল মজিদ বলেন, ইদানীং সিএনজিতে যাত্রী পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে। এক সময় রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে সিএনজিতে প্রচুর যাত্রী পাওয়া গেলেও বর্তমান সময়ে রাইড শেয়ারিং এ্যাপস আসার পর থেকে মানুষ আর বাধ্য না হলে সিএনজিতে চড়ে না। মনে করেন এখান থেকে কেউ একজন ধানমন্ডি যাবে এ্যাপস চাপল আর গাড়ি বা মোটরসাইকেল হাজির। মানুষের আর দরদাম করে সিএনজি খুঁজতে হয় না। বাসার গেইটে রাইড শেয়ারিং গাড়ি চলে যায়। যে কারণে আমরা পড়েছি বিপদে।
নিজেদের বিপদের বিষয় বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের যাদের নিজের সিএনজি নেই তাদের সারাদিনের জন্য সিএনজি জমা লাগে ৯০০ টাকা। কিন্তু মালিকরা আমাদের কাছ থেকে ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। এরপর সারাদিনের জন্য গ্যাস লাগে ৩০০ টাকার। সারাদিনের নিজের লেবার খরচ, খাওয়া-দাওয়া আছে। তাহলে কীভাবে মিটারে যেতে পারি? আগে যদি সারাদিনে ১০টা ট্রিপ মারতাম এখন সেটা হয়ে গেছে ৫-৬টা। কারণ মানুষ আর সিএনজিতে যেতে চায় না। এখন তারা রাইড শেয়ারিং এ্যাপসের গাড়িতে বা মোটরসাইকেলে যায়। আগে সব খরচ বাদ দিয়ে সারাদিনে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা ইনকাম করলেও এখন আয় হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। সব বিপদ যেন আমাদেরই।
গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের পাশে দাঁড়ানো আরেক সিএনজি অটোরিক্সা চালক হামিদুর রহমান জানালেন একই ধরনের অভিযোগ। তিনি বলেন, এতসব খরচের মধ্যে যদি সরকার নির্ধারিত মিটারে চলাচল করি তাহলে কীভাবে পোষাবে আমাদের? এমনিতেই আগের চেয়ে অর্ধেক ট্রিপ পাই আমরা, তাহলে এর মাধ্যেও যদি মিটারে যাওয়া লাগে তাহলে এই পেশা ছেড়ে দিতে হবে। সাধারণ যাত্রীদের আগে থেকেই সিএনজি অটোরিক্সার প্রতি তেমন একটা আস্থা ছিল না, এর ওপরে বর্তমান সময়ে যুক্ত হয়েছে রাইড শেয়ারিং এ্যাপস যে কারণে যাত্রীরা সব এখন ওদিকে ঝুঁকেছে। আর বর্তমানে আমাদের এই পেশা ছেড়ে দেয়ার উপক্রম হয়েছে।
২০১১ সালে সিএনজি অটোরিক্সার সরকার নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা এবং বিরতিকালীন চার্জ ১ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ভাড়া ও জমা বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে সিএনজির জমা ৯০০ টাকা এবং যাত্রীদের জন্য প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা, পরে প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং বিরতিকালীন চার্জ প্রতি মিনিটে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোন সিএনজি চালক এই ভাড়া একদমই মানেন না। বরং তারা তাদের নিজেদের ইচ্ছে মতো যাত্রীদের কাজ থেকে ভাড়া আদায় করেন।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডা থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় করছিলেন রাজীব আহমেদ নামের একজন বেসরকারী চাকরিজীবী। পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে নিয়ে কমলাপুর স্টেশন থেকে রাজশাহীগামী ট্রেন ধরবেন তিনি। রাস্তায় এসেই রাইড শেয়ারিং এ্যাপসের মাধ্যমে একটি প্রাইভেটকার ডেকেছেন ইতোমধ্যেই। গাড়ির জন্য অপেক্ষার মাঝেই কথা হয় রাজীব আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও যেতে চাইলে সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে হতো, তারা কেউই মিটারে যেতে রাজি হতো না। বাধ্য হয়েই তাদের দাবি করা ভাড়াতেই যেতে হতো। এখন আর আমাদের মতো সচেতন যাত্রীরা সিএনজি অটোরিক্সায় চলাচল করে না। বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং এ্যাপসের মাধ্যমে ঝামেলাহীন যাতায়াত করে। যেখানে নির্ধারিত ভাড়া, নিজের বাসার গেট থেকেই যে কোন দূরত্বে যাওয়া যায়। এসব কারণে আমিও লক্ষ্য করেছি সিএনজি চালকরা আর আগের মতো ভাড়া পায় না, রাস্তায় যাত্রীদের জন্য বসে থাকতে হয় তাদের। হয়তবা তারাও যদি ভাল সার্ভিস দেয়, যাত্রীদের চাহিদামতো কাক্সিক্ষত দূরত্বে মিটারে যাওয়া আসা করে তবে যাত্রীরাও আগের মতো সিএনজি অটোরিক্সায় চলাচল করবে।
৯৮ ভাগ সিএনজি অটোরিক্সা মিটারে চলে না ॥ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুসারে অটোরিক্সা নৈরাজ্য চিত্রে উঠে এসেছে সিএনজি অটোরিক্সা চুক্তিতে চলে ৯৮ ভাগ, বকশিশ দাবি করে ৯২ ভাগ, পছন্দের গন্তব্যে যায় না ৮৮ ভাগ, মিটারবিহীন চলে ৬২ ভাগ।
‘প্রতিস্থাপনের পর কেমন চলছে অটোরিক্সা?’ এই শিরোনামে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির সদস্যরা সাম্প্রতি রাজধানীর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ২৫৬টি অটোরিক্সায় যাত্রী সেবার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এই সময়ে ৩১০ জন অটোরিক্সা যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করে তারা। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত অটোরিক্সার ৯৮ ভাগ চুক্তিতে চলাচল করছে। মিটারে চলাচলকারী অটোরিক্সার ৯২ শতাংশ ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া বা বকশিশ দাবি করে। তবে বৃষ্টি বা সরকারী ছুটির আগেরদিন অথবা গণপরিবহন সঙ্কটকালীন সময়ে এই বকশিশের পরিমাণ ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। যাত্রীদের চাহিদার গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮৮ ভাগ অটোরিক্সা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিস্থাপনের পরও সিএনজি অটোরিক্সায় শৃঙ্খলা ফেরেনি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের যাত্রী সাধারণের বাহন হিসেবে পরিচিত দেশীয় প্রাকৃৃতিক গ্যাসে নামমাত্র খরচে পরিচালিত সিএনজি চালিত অটোরিক্সার মালিক, চালক, সরকার মিলে যাত্রীস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ৪ দফা ইকোনমিক লাইফ ও ৪ দফা যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধি, পরে একই মালিকের হাতে নতুন অটোরিক্সা তুলে দিয়েও এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। ভাড়া নির্ধারণে এক লাফে যাত্রী ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়িয়েও এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। এছাড়াও পর্যবেক্ষণকালে প্রাইভেট অটোরিক্সা ভাড়ায় যাত্রী বহন এবং ঢাকা জেলার অটোরিক্সা বেআইনীভাবে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রবেশ করে ৬২ শতাংশ গাড়ি মিটারবিহীনভাবে চলাচল করতে দেখা গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাড়া বা অটোরিক্সা চালকের পছন্দের গন্তব্যের সঙ্গে মিললেই কেবল যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হয়। চুক্তিতে চলাচলকারী অটোরিক্সায় মিটারের ভাড়া থেকে সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ সর্বোচ্চ ৭১০.৮১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যা এ্যাপসভিত্তিক চলাচলকারী ১৩০০-১৫০০ সি.সি. প্রাইভেটকারের ভাড়ার চেয়েও বেশি।
সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে যাত্রীদের দুর্ভোগ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, নতুন অটোরিক্সা নামানোর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি গণমালিকানার পরিবর্তে কোম্পানিভিত্তিক অথবা এ্যাপসভিত্তিক অটোরিক্সা পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। জমা ও ভাড়া বৃদ্ধি, সিলিং নির্ধারণ, মনিটরিং কমিটিতে যাত্রীসাধারণের প্রতিনিধিত্ব রাখাতে হবে। নতুন অটোরিক্সা নিবন্ধনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।