ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের প্রস্থান, বসন্তের আগমন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

প্রকাশিত: ১২:০৯, ২ এপ্রিল ২০১৯

শীতের প্রস্থান, বসন্তের আগমন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

শীতকালের প্রস্থান হলো, যদিও রাত হলে তার আমেজ এখনও কিছুটা বোঝা যায়। দিনের বেলাটা এখন বেশ গরমই থাকে। এখন চলছে বসন্ত, যার ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে আর প্রাণে। ঋতুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন বা রোগব্যাধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর প্রভাবে চারদিকে চলছে কিছু কিছু রোগ-বালাই আর স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা। এগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন, নিতে হবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। বসন্তের উষ্ণ আবহাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে আর বাতাসের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সাধারণ সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে শুরু করে জলবসন্ত আর হামজাতীয় রোগব্যাধির প্রকোপ এ সময়টাতে বেশি দেখা যায়। বাতাসে ছড়ানোর কারণে এগুলো খুবই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে, খুব দ্রুতই একজন থেকে অন্য জনে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যায় বাসায় একজন আক্রান্ত হলে অন্য সকলেই ধীরে ধীরে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিটি অফিসে বা ছোট বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়। তাই এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে হলেও আলাদা রাখা দরকার, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের থেকে এদের পৃথক রাখতে হবে। ঋতু পরিবর্তনের সময় ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবাই সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ডে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এই রোগে প্রায়ই দুই তিন দিন নাক বন্ধ থাকে, নাক দিয়ে পানি ঝরে, হাঁচির সঙ্গে সঙ্গে গলাব্যথা করে, শুকনা কাশি থাকে, জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত, লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিৎসা, এমনকি কোন চিকিৎসা ছাড়াই ভাল হয়, কোন এ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনা কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, এর সঙ্গে এ্যান্টিহিস্টামিন খেতে হবে। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পর পরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ বের হলে এবং সঙ্গে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে ক্ষেত্রে এ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাতে আরও একটি ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় যাকে বলে সিজনাল ফ্লু। এই রোগের লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোন চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না, উপরের কমন কোল্ডের মতোই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিলেই ঠিক হয়ে যায়। জলবসন্ত হলে প্রথমে একটু জ্বর, শরীরে প্রচ- ব্যথা আর সর্দি দেখা দেয়। তারপর গায়ে ফোস্কার মতো ছোট ছোট দানা উঠে, সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা, অরুচি ইত্যাদি। এটাও কোন মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে এ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আর সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। বসন্তে গাছে গাছে থাকে হাজারো ফুলের সমাহার, আর তার সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়ায় ফুলের পরাগরেণু। এসব রেণু এ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। এ্যালার্জি জনিত এ্যাজমা বা হাঁপানির অন্যতম কারণ এই পরাগ রেনু। এই সময় বাতাসে এ্যালার্জেন বেশি থাকায় হাঁপানি, এ্যালার্জিক রাইনাইটিসসহ অন্যান্য এ্যালার্জিজনিত রোগের প্রকোপও বেড়ে যায়। তাই এই পরাগরেণু এড়িয়ে চলাই ভাল। প্রয়োজনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা ভাল, বিশেষ করে যাদের বাইরে বেশি কাজকর্ম করতে হয়। সাইনোসাইটিস এবং টনসিলাইটিস জাতীয় রোগগুলোও এই সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারোরই হতে পারে, তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাবার প্রাক্কালে গরমের শুরুতে ঠাণ্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতা এর কারণ। এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য জায়গায় ধুলাবালিতে খেলাধুলা করলেও এ সমস্ত রোগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা পরিবর্তন আর ধুলাবালির কারণে এ সময়টাতে হাঁপানি, ব্রঙ্কিওলাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগের তীব্রতা আর আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যায়। ফুসফুসের রোগ ছাড়াও এই সময়টাতে অনেকেই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। দেখা যায় অনেকেই প্রচ- গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র অপরিষ্কার পানি বা শরবত পান করেন। এ ছাড়া গরমের কারণে খাবার দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, আর এসব খাদ্যদ্রব্য খেয়ে অনেকের ডায়রিয়াজনিত রোগ-ব্যাধি, এমনকি টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে। শীত-বসন্তের আবর্তনে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই মোটামুটি সুস্থ থাকা সম্ভব। ধুলাবালি পরিহার করতে হবে, অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলতে হবে। ঘাম হলে মুছে ফেলুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠাণ্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধুলাবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে অনেক রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, যেখানে সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় পান বর্জন করতে হবে। গরমের কারণে এই সময় পানি বা অন্যান্য তরল পানীয় গ্রহণ করতে হবে একটু বেশি, তবে তা যেন অবশ্যই বিশুদ্ধ হয়। বিশেষ করে যারা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজকর্ম করেন তাদের বেলায় তরল পানীয়ের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। ওরস্যালাইনও খেতে পারেন। ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। সময়ের সঙ্গে আসবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। প্রকৃতি সেজে উঠবে বিভিন্ন রূপে, এক সময় অপরূপ, আবার অন্য সময় বিরূপ। আর এর সঙ্গে একেক ঋতুতে একেক রোগ-ব্যাধির প্রকোপও দেখা দেবে। তাই সুস্থ থাকার জন্য ঋতুভেদে কিছু সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×