ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিঙ্গাপুরের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ

গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণে মারাত্মক অনিয়ম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২৪ মার্চ ২০১৯

গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণে মারাত্মক অনিয়ম

রশিদ মামুন ॥ মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণে ভয়াবহ অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে পেট্রোবাংলা। সিঙ্গাপুরের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দরপত্রের শর্ত ভেঙ্গে অন্য কোম্পানির যন্ত্রাংশ স্থাপন করে ১০৩ কোটি টাকার বিল নিয়ে চলে গেছে। এখন পাইপলাইন এবং গ্যাস স্টেশনের মান নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে পেট্রোবাংলা। ঠিকাদার কেবল নিজের ইচ্ছামতো যন্ত্রাংশ স্থাপন করাই নয় এসব যন্ত্রাংশের সনদও প্রদান করেছে। নিয়ম অনুযায়ী যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দেশ এবং প্রতিষ্ঠানকে এর নিরাপত্তা সনদ দিতে হয়। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা সকল পণ্যের নিরাপত্তা সনদ দিয়েছেন। পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা কৌশল) মোঃ জহিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দরপত্রের সঙ্গে যেসব যন্ত্রাংশ দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে তা না দিয়ে পাইপলাইনে নিজেদের ইচ্ছামতো যন্ত্রাংশ বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপন করেছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি জিটিসিএল। একই সঙ্গে মিটারিং স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে। যার পুরো কাজের ঠিকাদার ছিল সিঙ্গাপুরের কোম্পানি এমারসন প্রসেস ম্যানেজমেন্ট এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেড। পাইপলাইন স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগে পেট্রোবাংলা তদন্ত কমিটি গঠন করলে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এই ঘটনা। দরপত্রে যাদের যন্ত্রাংশ সংযোজনের কথা বলা হয়েছে তা না করে অন্য প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়েছে। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, দরপত্রে সব সময় ভাল মানের যন্ত্রাংশের কথাই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু যখন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয় তখন দেখা যায় নি¤œমানের কম দামের যন্ত্রাংশ দিয়ে কাজ করে চলে যাচ্ছে। আবার তারা কাজের পর বিলও নিয়ে চলে যাচ্ছে। এসব কাজে প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্টরা দায়ী। এতে দুই পক্ষের লাভ হলেও প্রকল্পটি ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে প্রকল্পের কোন যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে তার ওয়ারেন্টি পাওয়া যায় না। তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণের ৪/৫ এ লিখেছে ‘ নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মালামালের বিল, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সনদ এবং নিরাপত্তা সনদ পাওয়ার পর তা মূল্যায়ন করে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এলসি খোলার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এলসিতে আমদানিকারক হিসেবে ব্যাংকের নাম এবং নোটিফাইং (জ্ঞাপক) ক্রয়কারীর নাম এবং আমদানিকারক হিসেবে ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এখানে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি (জিটিসিএল) এর নাম এবং নোটিফাইং হিসেবে বেসিক ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এলসি খোলার সময় থেকেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দিয়ে রাখা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, নক আউট ড্রাম, ফিলটার সেপারেটর, লিক্যুইড সেপারেটর, ওয়াটার বাথ হিটার, কনডেনসেট ট্যাঙ্ক, সিনিয়র ওরিফিস মিটার, প্রেসার রিডিউসিং রেগুলেটর, কন্ট্রোল ভালব, বল ভালব, গ্লোব ভালবসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের গুণগত মান পরীক্ষা না করেই ঠিকাদারকে অর্থ ছাড় করা হয়েছে। মিল টেস্ট সার্টিফিকেট এবং ওয়ারেন্টি সার্টিফিকেট এ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার সই করে দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যা করতেই পারে না। এখন যদি এই যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে জিটিসিএল-এর নিরাপত্তা পাবে না। পেট্রোবাংলা তার পর্যবেক্ষণে বলছে, প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা এবং সঠিকভাবে কাজ বুঝে নেয়ার জন্য প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্টদের প্রকল্প এলাকায় থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনা এনইসি সভায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। কিন্তু এরকম বৈধ নির্দেশনা থাকার পর প্রকল্প পরিচালক প্রকল্প এবং সংশ্লিষ্টরা প্রকল্প এলাকায় না গিয়ে চাকরি প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করেছেন। যদিও জিটিসিএল বলছে প্রকল্প কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় থাকতেন তবে ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে তাকে থাকতে হতো। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারী বড় কাজের পরিচালকরা অধিকাংশ সময়ই ঢাকায় থাকেন। এরা মাঝে মাঝে প্রকল্প এলাকায় গেলেও কেউ স্থায়ীভাবে সেখানে থাকেন না। এতে করে ঠিকাদার তার নিজের ইচ্ছায় কাজ করে। প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেয়ার সময়ই প্রকল্প পরিচালকরা সক্রিয় হন। শুধু যন্ত্রাংশ নয় পূর্তকাজের মান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে পেট্রোবাংলা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বলছে তারা ভিয়েতনামের পাথর ব্যবহার করছে। কিন্তু আদৌ ভিয়েতনামের পাথর ব্যবহার হয়েছে কি না বা তা কোন মানের তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে জিটিসিএল এর কোন কর্মকর্তাই সেখানে উপস্থিত না থাকায় পাথর সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। যন্ত্রাংশ স্থাপনে অনিয়ম সম্পর্কে তদন্ত কমিটি বলছে, সরেজমিনে গ্যাস স্টেশনটি পরিদর্শনের সময় ভালব এর উপর ভিরগো ভালব ইতালির নাম ফলক দেখা গেছে। কিন্তু চুক্তিতে ভিরগো ভালভ ইতালির নাম নেই। ঠিকাদারের জাহাজীকরণ দলিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এসব নন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এসেছে। যা আসল শিপিং ডকুমেন্ট নয়। কিভাবে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে মালামাল আমদানি করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়েছে তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। জিটিসিএল এর দলিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কান্ট্রি অব অরিজিন আর সনদও দিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৫ এর ৬ (খ) অনুযায়ী রফতানিকারক সংশ্লিষ্ট সরকার বা ওই দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এই সনদ দেয়ার এখতিয়ার রাখে। এছাড়া মিল টেস্ট এবং ওয়ারেন্টি সনদ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে যাও দিয়েছে সিঙ্গাপুরের এই কোম্পানিটি।
×