ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বের মোট ইলিশের ৭৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:২০, ১৪ মার্চ ২০১৯

 বিশ্বের মোট ইলিশের ৭৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ জাতীয় সম্পদ ইলিশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে এক শতাংশের বেশি অবদান রাখছে এই ইলিশ। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সবাই এখন সাধ্যের মধ্যেই পাচ্ছেন সুস্বাদু এই মাছ। সরকারের নানামুখী কর্মকৌশলের ফলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন জাটকা নিধন কার্যক্রম, মা ইলিশ সুরক্ষা ও ডিম ছাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা, ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বহুমুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে সরকার ইলিশ উৎপাদন এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরিবেশ নিশ্চিত করতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। আর তাতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গত ৯ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৭৫ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। ১০ বছর আগেও দেশের মাত্র ২১ উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ইলিশ দেশের ১২৫ উপজেলার নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন, যা গত ৯ বছরে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। সরকারের কর্মকৌশল আর পরিকল্পনার কারণেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে জানান মৎস্য কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিকেজি ইলিশের দাম কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে হিসেবে ধরলেও উৎপাদিত ইলিশের বাজারমূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই বাজারের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ‘কোন জাল ফেলবো না, জাটকা-ইলিশ ধরব না।’-এই স্লোগানে আগামী ১৬ থেকে ২২ মার্চ (৭ দিন) জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করবে সরকার। ইলিশ অধ্যুষিত ৩৬ জেলায় এ সপ্তাহ পালিত হবে। যদিও এটি আগামী ১০ মার্চ থেকে পালন করার কথা ছিল। এবার ভোলা জেলার চরফ্যাশনে এই জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের উদ্বোধন করা হবে। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে সংশ্লিষ্ট ৩৬ জেলা-উপজেলায় সচেতনতামূলক ভিডিওচিত্র-প্রদর্শন, টিভি-রেডিও মোবাইলে প্রচার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জাটকাসংরক্ষণ আইনের প্রচারের পাশাপাশি জালসহ জাটকা ক্রয়-বিক্রয়, বাজারজাতের বিরুদ্ধে ব্যাপক পুলিশী অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। সপ্তাহপালনের আওতাভুক্ত জাটকাসমৃদ্ধ ৩৬ জেলা হচ্ছে- ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, জামালপুর, পাবনা, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা। জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করতে জুন ২০১৭ পর্যন্ত ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধন ও ডাটাবেজ প্রস্তুত এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ইলিশ আহরণে জড়িত প্রায় ৭ লাখ জেলে এবং মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে ২২ দিনের জন্য ৩ লাখ ৯৫ হাজার জেলে পরিবারের প্রতিটিকে ২০ কেজি হারে প্রায় ৭ হাজার টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়। এছাড়াও ইলিশ উৎপাদনের সফলতা ধরে রাখার জন্য দেশের ১৫ জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২ জেলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার। মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ থাকার সময়ে প্রতি জেলে পরিবারকে মাসে ১০ কেজি হারে খাদ্য দেয়া হলে বর্তমানে ৪০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০০৭-০৮ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৩৫ জেলে পরিবার এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বর্তমানে পরিবার সংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪-তে উন্নীত হয়েছে। এতে করে প্রান্তিক জেলেরাও বেশ খুশি। খাদ্য কর্মসূচীতে জেলেদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অনেকেই এই সময়গুলোতে ইলিশ নিধন থেকে বিরত থাকে। ইলিশ নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন মাসুদ আরা মমী যিনি মৎস্য অধিদফতরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক। এবারের জাটকা সপ্তাহ নিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, জাটকা সংরক্ষণে এখনও নিষেধাজ্ঞা চলছে। ১০ ইঞ্চির নিচের মাছগুলোকে জাটকা বলা হয়। প্রতিবছরই ৮ মাস অর্থাৎ নবেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা ধরা নিষেধ থাকে। একে আমরা বলি জাটকা নিধন প্রতিরোধ কর্মসূচী। এই কর্মকর্তা আর বলেন, যেহেতু অক্টোবর মাসে ইলিশের ডিম ছাড়ে এবং নবেম্বর ও ডিসেম্বরে খুবই ছোট থাকে মাছ। ফেব্রুয়ারি শেষে বা মার্চে জাটকা বেশ বড় হয় আর অনেকেই ধরতে চায়। তাই এই সচেতনতা কর্মসূচী। এছাড়াও আমাদের ৬টি অভয়াশ্রম রয়েছে যেখানে একটিতে জানুয়ারি থেকে মার্চ এবং বাকি পাঁচটিতে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস সম্পূর্ণ মাছ ধরা নিষেধ। এই কর্মকর্তা ইলিশের উৎপাদন নিয়ে বলেন, দেখুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫.১৭ লাখ মে. টন আর তার আগের বছর ছিল ৪.৯৬ লাখ মে. টন। নানা পদক্ষেপের কারণেই তো উৎপাদন বাড়ছে। ইতোমধ্যে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আইনানুগ কার্যক্রম শেষে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের ভৌগোলিক নিবন্ধন (জিআই সনদ) প্রদান করে। ভৌগোলিক নিবন্ধন সম্পন্নের ফলে এখন মানসম্পন্ন ইলিশ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বাণিজ্যিকসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যাবে বলেও জানা গেছে। মৎস্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সালেহ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জাতীয় এই সম্পদ রক্ষার জন্য সব ধরনের প্রচার করতে চাই। এটি অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও থাকছে। মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় বয়ে যাওয়া নদীগুলোতে ইলিশ ধরা পড়লেও বিশেষ করে চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর হচ্ছে ইলিশ অধ্যুষিত জেলা। এই জেলাগুলোর আশপাশের নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলা হয়েছে ইলিশের অভয়ারণ্য। সাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক এসব জেলার আশপাশের নদীগুলোয় এসেই ডিম ছাড়ে। একটি মা-ইলিশের পেটের দুই ফালি ডিম থেকে সর্বনিম্ন দেড় লাখ এবং সর্বোচ্চ ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম হয়। ভোলা জেলার মনপুরা, ঢালচর, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের বিশেষ প্রজনন এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মাসহ চাঁদপুরের মেঘনা, ভোলার তেঁতুলিয়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, পটুয়াখালীর পায়রা, আগুনমুখা, পিরোজপুরের বলেশ্বর এবং সন্ধ্যা নদীর মাছের স্বাদ সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু জনকণ্ঠকে বলেন, ইলিশ কিন্তু কারও একক সম্পদ নয় এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। আর জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে আমরা নানা কর্মসূচী হয়তো নেই তবে এক্ষেত্রে সবার এগিয়ে আসতে হবে। এক সপ্তাহ জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ ঘোষণা করা হয়েছে যা এবার আমরা ভোলাতে এর উদ্বোধন করতে চাই। আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলেদের নানা ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে যাতে করে আমরা এই সময়গুলোতে ইলিশকে রক্ষা করতে পারি। তবে কেউ আদেশ অমান্য করলে শাস্তি তো আছেই, অভিযান চলবে। সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন সর্বস্তরে সচেতনতা আর সবার এগিয়ে আসার মাধ্যমে আগামী দিনে আরও বাড়বে রুপালি ইলিশ।
×