ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদীর পানিতে বাঁধ দেয়ায় আমি বিশ্বাসী নই ॥ অরুন্ধতী রায়

প্রকাশিত: ১২:৪২, ৬ মার্চ ২০১৯

নদীর পানিতে বাঁধ দেয়ায় আমি বিশ্বাসী নই ॥ অরুন্ধতী রায়

মনোয়ার হোসেন ॥ পৃথিবীর বিখ্যাম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এর রচয়িতা অরুন্ধতী রায়। কথার জাল বুনে মুগ্ধ করলেন অনুরাগীদের। নানা পথে বাঁক নিয়েছে তার শব্দমালা। সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে রাজনীতির পথে এগিয়েছে কথোপকথন। অধীর আগ্রহী শ্রোতাদের মনের খোরাক জুগিয়েছে তার বক্তৃতার বিষয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হলো ম্যান বুকারজয়ী এই ভারতীয় কথাশিল্পী ও মানবাধিকার কর্মীর কথোপকথন পর্ব। ছবিমেলার অংশ হিসেবে ধানম-ির মাইডাস সেন্টারের ইএমকে কনফারেন্স কক্ষে এই আলাপচারিতার আয়োজন করা হয়। সবার সুযোগ হয়নি এই আলাপন শোনার। নিবন্ধনের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান কিছু শ্রোতা উপভোগ করেছেন বিশ্বখ্যাত এই ঔপন্যাসিকের বক্তব্য। পর্বটি সঞ্চালনা করেন ছবিমেলার উৎসব পরিচালক শহীদুল আলম। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার নদীর পানি বণ্টন এবং বাঁধ সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে অরুন্ধতী বলেন, আমি নদীর পানিতে কোন বাঁধ, গেট, প্রতিবন্ধকতা আরোপে বিশ^াসী নই। এগুলো নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। ভারতের নদী অংশে বাঁধ দেয়ার বিষয়ে লেখিকা বলেন, এই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে শত শত একর জমি নষ্ট হয়েছে। অসংখ্য আদিবাসী ভূমিহীন হয়েছে। এগুলো নির্মাণের আগে আমাদের আরও বেশি মানবিক হওয়া উচিত। আলাপচারিতার মাঝে তিনি ‘ভাইজি ভাইজি’ নামের একটি আদিবাসী চরিত্রের মধ্য দিয়ে বাঁধের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসের জন্য বিশে^র আলোচিত ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন অরুন্ধতী। এখন পর্যন্ত বইটি ৪২টি ভাষায় ৬ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। বইটির বিষয়ের জিজ্ঞেস করা হলে লেখিকা বলেন, যদি কুড়িজন পাঠকও এটি পড়ত তাহলেও আমার উপন্যাসটি একইরকম থাকত। দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে আমি বই লিখেছি। প্রথম লেখা বই এতটা আলোচিত হওয়ায় অনেকেই বলেছে, এটি নিয়ে আমার উচ্চাশা ছিল। তবে নিজের ভেতরে একটা উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল যে বইটি যেন বেশি মানুষ পড়ে। লেখক হিসেবে যখন তিনি রীতিমতো তারকায় পরিণত হয়েছেন তখন সে অবস্থান তিনি ঝুঁকলেন রাজনীতিবিষয়ক লেখালেখিতে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বুকার জেতার পর ভারতের প্রতিটি ম্যাগাজিনে আমার ছবি ছাপা হয়েছে। একটা সময়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলো। তার পরপরই একটি পারমাণবিক পরীক্ষার ঘটনা ঘটল। সবাই খুব উচ্ছ্বসিত। সবার ভেতরে জাতীয়তাবোধের বীজ আরও উসকে উঠল। সে সময় আমি প্রথম লিখেছিলাম রাজনীতিনির্ভর প্রবন্ধ ‘দ্য এ্যান্ড অব ইমাজিনেশন’। আমার কাছে মনে হলো, আমরা নতুন এক ঔপনিবেশিক যুগে ধাবিত হচ্ছি। ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে আমাদের চিন্তার জগত। ছবিমেলায় কেন এসেছÑ এই প্রশ্নের জবাবে অরুন্ধতী বলেন, তোমার জন্য এসেছি। তোমাদের জন্য এসেছি। এখানে নতুন প্রজন্মের একঝাঁক মানুষকে দেখতে পাচ্ছি; যারা আলোকচিত্র নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজগুলো দেখতে খুব ভাল লাগছে। পাঠশালা নামে তোমাদের আলোকচিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও আমার ভাল লেগেছে। উপমহাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খুব কম আছে। ভারতের চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলাসহ শিল্প-সাহিত্যেও নানা অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে আর্টিস্ট ইউনাইট নামের একটি প্ল্যাটফরম নিয়ে কাজ করছেন অরুন্ধতী। ওই কাজেরই অংশ হিসেবে একবার প্রচুর বলিউড তারকাও সেখানে অংশ নেয়। এ কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ সময়কালে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষরা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল। কিন্তু এই মানুষগুলো ছিল একেবারেই নিরপরাধ। রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার কাছে এই মানুষগুলো একেবারেই অসহায় ছিল। এ কারণেই সেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। শৈশবের স্মৃতিচারণে অরুন্ধতী বলেন, আমার বয়স যখন চার কিংবা পাঁচ তখন আমার বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়। সেসময় আমি একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে মিস মিটেন নামের এক শিক্ষিতা আমাদের পড়াতেন। তিনি আমাকে আঙ্গুল গুনে গুনে সংখ্যার যোগ-বিয়োগ শেখাতেন। একদিন আমাকে দশ সংখ্যার বেশি একটি যোগ অংক করতে দিলেন। যেটা তিনি নিজের পায়ের আঙ্গুলের উদাহরণ দিয়েও বোঝাতেন। আমি সেরকম কিছু না করে সঠিক উত্তর দিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এটা কিভাবে করলে? জবাবে বললাম, আমার মাথা থেকে। যতদূর মনে পড়ে, আমার লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাক্য ছিল ‘আই হেট মিস মিটেন’। বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের বিষয়ে লেখিকা বলেন, উপমহাদেশে আশি শতকের দিকে গণতন্ত্রের যে ধারাটি ছিল সেটি এখন শুধুই নির্বাচনকেন্দ্রিক। এই অঞ্চলের এখন গণতন্ত্র মানেই যেন নির্বাচন। এসময় তিনি ‘লাইফ আফটার ডেমোক্রেসি’ নামের একটি লেখা থেকে পাঠ করেন। এই সময়ের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বিশ বছর আগে যখন উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হতো তখন মানুষকে বোঝানো হতো উন্নয়ন হলে মানুষ চাকরি পাবে, কর্মসংস্থান হবে, দারিদ্র্য দূর হবে। কিন্তু খোদ ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। উন্নয়ন মানেই বিনিয়োগের লভ্যাংশ সর্বোচ্চ পরিমাণ বাড়ানো। এই উন্নয়নের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সামান্যসংখ্যক মানুষ লাভবান হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি আম্বানি পরিবার ও তাদের ব্যবসার ক্রমাগত বিস্তৃতির কথা তুলে ধরেন। রাজনীনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততাবিষয়ক প্রশ্নের জবাবে এই রাজনৈাতিক সক্রিয়তাবাদী বলেন, আমি ভারতের মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। তাদের রাজনৈতিক দর্শনকে অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। সেজন্য জঙ্গলে তাদের সঙ্গেও বহুদিন কাটিয়েছি। আর এ কারণে আমার পাঁচটি ক্রিমিনাল কেসও হয়েছে।
×