ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসির সিয়াম

নাভেনের বইমেলা প্রীতি

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নাভেনের বইমেলা প্রীতি

কানাডা থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে বাংলদেশে এসেছে নাভেন। জন্মের পর এবারই ওর প্রথম নিজের দেশে আসা। আসলে নাভেনের জন্মের আগে থেকেই বাবা-মা দুজনেই কানাডায় বসবাস করতেন। ছাত্রজীবনে স্কলারশিপ নিয়ে নাভেনের বাবা কানাডায় পড়তে যান। পড়ালেখা শেষ করে ওখানকারই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর দেশে এসে বিয়ে করে বউকে নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। প্রতিবছর এই সময়টায় ছুটি কাটাতে দেশে আসতেন দুজনেই। কিন্তু নাভেনের জন্মের পর বেশ কয়েক বছর যাবত ছুটি কাটাতে আর দেশে আসা হয়নি তাদের। নাভেনের জন্ম কানাডাতে। ওখানকার আবহাওয়া আর বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আকাশ পাতাল তফাত। তাছাড়া ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এতদূর যাতায়াত করাটাও সমস্যা। যার জন্য মাঝখানে কয়েকটা বছর তাদের আর দেশে আসা হয়নি। তবে এখন নাভেন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তার মানে বেশ বড়ই হয়েছে ও। এখন আর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আবহাওয়ায় এসে চলতে কিংবা যাতায়াতে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা না ওর। তাই এ বছর মোটামুটি গুছিয়ে লম্বা একটা ছুটি কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই দেশে এসেছেন নাভেনের বাবা-মা। দেশে এসে ঢাকায় বড় ভাইয়ের বাসায় স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে উঠেছেন নাভেনের বাবা। নাভেনকে নিয়ে পুরো বাসাজুড়ে একটা আহ্লাদে ভাব শুরু হয়েছে। একে তো প্রথমবারের মতো দেশে এসেছে নাভেন। এর ওপর বাবা-মা ছাড়া পরিবারের আর সবাই এই প্রথমবারের মতো চোখে দেখছে নিজেদের ছেলেকে। আদরে আহ্লাদে নাভেনও ভীষণ আনন্দ করেই দিনগুলো পার করছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বড় চাচা ওর জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে আসছেন। বড় চাচি আর দাদি মিলে ভাঁপা, পুলি, দুধপুলি, পাটিসাপটা, দুধ চিতই, চুটকি পিঠাসহ শীতের সব মজার মজার পিঠা তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন। এসব পিঠা নাভেন কখনও চোখেই দেখেনি। নতুন নতুন এসব মজার খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নাভেন বেশ মুগ্ধ। ঘরে বসেই যে এত মজার মজার খাবার বানানো যায় ও হয়তো সেভাবে জানতেই পারত না দেশে না আসলে। তবে নাভেনের সবচেয়ে বেশি খাতির জমেছে ওর বড় চাচার মেয়ে অধরার সঙ্গে। অধরা ওর বাবার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ভাইবোন ছাড়া একা একা বড় হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে অধরা। এদিকে নাভেনও কানাডায় একাই থাকে। দুজনেই ভাই-বোনের ভালবাসার যে সুন্দর একটা সম্পর্ক আছে তা নিজ থেকে কখনই অনুভব করার সুযোগ পায়নি। অধরা ঠিক যতক্ষণ বাসায় থাকে পুরোটা সময় যেন নাভেন একেবারে অধরা আপু অধরা আপু বলতে বলতেই দিশেহারা অবস্থা। অন্যদিকে অধরাও এই অল্প কয়েকদিনেই ছোট ভাইকে পেয়ে নিজেও খানিকটা ছোট মানুষের মতো হয়ে গেছে। ওরা দুজনে মিলে ভিডিও গেম খেলে, কার্টুন দেখে, ছাদের ফুল বাগানে পানি দেয় আরও কত কি কাজ! ফেব্রুয়ারি মাস চলে এসেছে। পুরোটা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই চলে দেশের ঐতিহ্যবাহী বইমেলা। বইমেলাটা যেন এক রকমের উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশের মানুষের কাছে। তাই তো মেলার প্রথম দিন থেকেই বইপ্রেমী মানুষের সমাগমে ভরে উঠে পুরো শাহবাগ এলাকা। অধরাও বই পড়তে ভীষণ ভালবাসে। ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে বইমেলায় যেত সে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বইমেলা শুরু হলে প্রতিদিনই ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে একবার করে বইমেলায় ঘুরে এরপর বাসায় ফিরে সে। এবারের বইমেলার প্রথম দিন ছুটির দিন থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে স্পেশালভাবে প্ল্যান করে বইমেলা থেকে ঘুরে এসেছে অধরা। বেশ কিছু বইও কিনেছে সে। বাসায় ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করতে যাবে এমন সময় নাভেন তার পাশেই ছিল। ছবিগুলো দেখে অধরাকে জিজ্ঞাসা করল নাভেন, এগুলো কিসের অনুষ্ঠানের ছবি আপু? -অনুষ্ঠান নারে বোকা। আজকে বইমেলায় গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। বইমেলায় ঘোরার সময়কার ছবি এগুলো। বইমেলা মানে কি বইয়ের অনেক দোকান? -হ্যাঁ, তবে এখানে একটু ভিন্ন রকম পরিবেশ। অনেক দোকান আছে বইয়ের। তবে এখানে সারা বছর বই বিক্রি হয় না। প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে কেবল বই বিক্রির এই উৎসবের আয়োজন হয়। অসংখ্য বইয়ের দোকান থাকে সেখানে। যারা বই পড়তে ভালবাসে তারা নতুন নতুন বইগুলো কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যন্ত চলে আসে। বইয়ের লেখকরাও পাঠকদের সঙ্গে দেখা করতে যান। লেখক পাঠক সবাই মিলে গল্প গুজবও হয় সময়ে সময়ে। -পুরো মাস জুড়েই কেন বইমেলা হয় আপু? -তুমি কি জান ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস? -হ্যাঁ। আব্বু আম্মু যখন আমাকে বাংলা ভাষা শেখায় তখন এর ইতিহাস সম্পর্কে শুনেছি। এই দিনে বাংলা ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই জীবন দিয়েছিলেন। তাঁদের জীবনের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। আর মাতৃভাষার জন্য এতটা ভালবাসা দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ বাংলা ভাষাকে সম্মান জানায়। তাই না আপু? -ঠিক তাই। এই জন্যই প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাই। আর ফেব্রুয়ারিকে বলি ভাষার মাস। যেহেতু এটা মূলত বাংলা ভাষার বইয়ের উৎসব, আর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। সেজন্যই ভাষার মাসজুড়ে বইমেলা হয়। আর এদেশের মানুষ এতটাই বই পড়তে ভালবাসে যে পুরো এক মাসজুড়ে বইমেলার মতো উৎসব পালনের পরও তাদের মন ভরে না। প্রতিবছরই অনেক মানুষ বইমেলার সময় আরও কিছুদিন বাড়ানোর দাবি করে। -আমাকে কি বইমেলায় ঘুরতে নিয়ে যাবে আপু? ছোট ভাইয়ের কথা শুনে খুশি হলো অধরা। কালকে ওর ক্লাস নেই। বইমেলায় যেতে পারার একটা দিন মিস হবে ভেবে একটু খারাপই লাগছিল। নাভেন বইমেলায় যদি যায় তবে একসঙ্গে দুজনেরই বইমেলায় যাওয়া হবে। অধরা উত্তর দিল, ওখানে কিন্তু লম্বা লাইন পেরিয়ে মেলার ভেতরে যেতে হবে। আবার অনেক মানুষের ভিড় থাকবে। ভয় করবে না তো আবার? -একদমই না। আমি সবসময় তোমার হাত ধরেই থাকব। আর আপু আমি কিন্তু বাংলা পড়তেও পারি। আমাকে অনেকগুলো বইও কিনে দিতে হবে। কোনদিন দেশের মুখ না দেখার পরও নিজ দেশের ভাষা শিখতে ছোট্ট একটা মানুষ যে কোন প্রকার ছাড় দেয়নি, আর ওর বাবা মাও যে সন্তানকে বাংলা ভাষা শিখিয়ে পড়িয়ে বাংলা ভাষাকে সম্মান জানিয়েছেন এজন্য অধরা মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। বলল, অবশ্যই কিনে দেব ভাইয়া। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠার পর নাস্তা শেষ করেই তাহলে আমরা বইমেলায় ঘুরতে যাব। ওখানে ছোটদের জন্য অনেক মজার মজার গল্প, কবিতা- ছড়ার বই আছে। সুন্দর সুন্দর রং আর ছবিতে সাজানো বইগুলো হাতে নিলেই দেখবে মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×