ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিলুপ্তির পথে মাটির গান

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

 বিলুপ্তির পথে মাটির গান

গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। বাউল সম্রাট ওস্তাদ শাহ্ আব্দুল করিম তার লেখনী ও কণ্ঠে কয়েক যুগ আগেই বাংলার লোকজ সংস্কৃতির চর্চায় সমৃদ্ধির আনন্দ উদযাপন এবং হারানোর কথা উল্লেখ করেছেন। আজ তার এ গানটি সত্যবাণীতে পরিণত হয়েছে। এখন সৈয়দপুরসহ উত্তরাঞ্চলের কোথাও আর মাটিতে বসে এ সংস্কৃতি উদযাপন হয় না। গাওয়া হয় না কোন গান। চর্চার অভাবে সময়ের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে মাটির গান। জানা গেছে, ধর্মীয়বোধ জাগ্রত, বাংলা ভাষা ও দেশের স্বাধীনতা, প্রকৃতি, মানুষের আচার, বিনোদন, আবেগ-অনুভূতি ও গ্রাম্য রীতিসহ সামগ্রিক বিষয় ফুটে উঠত এবং বার্তা পেত লোকজ সংস্কৃতিতে। পাকিস্তান ও তার পূর্ববর্তী সময়ে এসব গানে আজকের এ বাংলা ভাষা, দেশ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বাঙালীর স্বকীয়তা অর্জিত হয়েছে। প্রযুক্তির অনুপস্থিতিতে উত্তরের এ জনপদবাসীর মনের খোরাক ছিল মুর্শিদী, জারি পুঁথি, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, কবি পালা, বয়াতি, গাজি কালু চম্পাবতী, শরিয়ত-মারিফত, বিয়ের গীত, বেহুলা-লখিন্দর, ময়নামতি, বিষহরি, রামচন্দ্রের কাহিনী, মনসাসহ নানা ধরনের গান। মৌসুম অনুযায়ী চলত এসব গান। এতে লোকজ সংস্কুতির ভা-ার সমৃদ্ধ ছিল। যা টানা ৯০ দশক পর্যন্ত টিকেছিল এ জনপদ। মাটির গানে মিশে থাকত মা, মাটি ও দেশের মানুষের আবেগের গন্ধ। সারা দিনের কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যাবেলা উঠানে বসে তামাকের ডিব্বা নিয়ে রাত ভর চলত সুখ-দুঃখের গল্প কিংবা পুঁথিপাঠ। মাটিতে গোলাকার হয়ে বসে সেখানে একই ব্যক্তি বিভিন্ন রূপের অভিনয় আর গানের দৃশ্য চর্তুদিকের শ্রোতা উপভোগ করত। আবার অনেক গান হত মঞ্চেও। চর্চা হত রাখালের বাঁশিতে, কিষানের গলায়, গৃহস্থের বাড়ির উঠান কিংবা খুলিতে। বসত হাটে-ঘাটে পুঁথির আসর। গাজি কালু আর চম্পাবতীর কিসসা। যাত্রাপালা, বায়োস্কোপ, পুতুল নাচ, যাত্রাপালার অনবদ্য জনপ্রিয় চরিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা, রহিম-রুপবান কিংবা তাজেলের কথা অভিনয় আজও তাড়িত করে এ জনপদের মানুষকে। সৈয়দপুরসহ উত্তরের সব এলাকায় এই গানগুলোই মানুষের রক্তের শিরা-উপশিরায় মিশেছিল। তথ্যপ্রযুক্তির ধারাবাহিক উৎকর্ষতা ও গ্রামীণ জনপদে স্যাটেলাইট তরঙ্গ পৌঁছে যাওয়ায় মাটির গানগুলো বিদায় হয়েছে চিরতরে। খুঁজে পাওয়া যায় না বাউলদের। তাদের স্থানে বিদেশী হেভি মেটাল গান। যে গানে নাড়ির টান নেই। নেই শিক্ষার কোন বাণী। সৈয়দপুরের বন্ধন শিল্পীগোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এসব গানকে ধরে রাখতে ২০১৮ সালের নবেম্বর মাসে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চর্চার আসর বসিয়েছিল এবং এ জনপদের গুণী শিল্পী বিনয় কুমার রাজবংশী ও তার দল এ মাটির গান বিভিন্ন আজও চর্চা করছে। তাই এ শিল্পীর ব্যাপক কদর রয়েছে গ্রামাঞ্চলে। এ ছাড়া ভাওয়াইয়া ও বাউল সম্রাট ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিমের গান শোনা যায়। তবে মাটির গান নিয়ে উৎসব করতে আর কাউকে দেখা যায় না। শহরের মাটির গানের পুরনো শ্রোতা বেলাল উদ্দিন বলেন (৭০), আমাদের আছে বিশ্ব মানের আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলীম কিংবা লালন ফকির বা শাহ আবদুল করিমের গান। যাদের মাধ্যমে দেশীয় গান বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল। নানা কারণে হারিয়ে গেলেও এগুলোকে রমনার বটমূলে আবদ্ধ না রেখে একাডেমিকভাবে চালুর উদ্যেগ নিতে হবে। না হলে আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির জায়গা হবে জাদুঘরে। বন্ধন শিল্পগোষ্ঠীর সাধারন সম্পাদক ও শিল্পী রইজ উদ্দিন রকি বলেন, পশ্চিমা ও ভারতীয় সংস্কৃতি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রবেশের কারণে বর্তমানসহ ভবিষ্যত প্রজন্মদের কাছে গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অনুভূতি ভোঁতা হয়েছে। নগ্ন ও বিকৃত রুচির শিল্প দর্শনে তারা নৈতিকতা অবক্ষয়ে বিপথে যাচ্ছে। তাই গ্রাম্য সংস্কৃতি রক্ষায় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করতে হবে। সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শিল্পী সমিতির সহ-সভাপতি ও সুর ধ্বনির পরিচালক সুরকার ও গীতিকার শিল্পী বিনয় কুমার রাজবংশী বলেন, মাটির গানের চর্চা আমরা ধরে রেখেছি। -এম আর মহসিন, সৈয়দপুর থেকে
×