ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সালতামামি ২০১৮

গত বছর আলোচনায় ছিল পোশাক শ্রমিকের মজুরি

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২ জানুয়ারি ২০১৯

গত বছর আলোচনায় ছিল পোশাক শ্রমিকের মজুরি

রহিম শেখ ॥ রফতানিতে সুবাতাস, শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি ও পশ্চিমা দুই ক্রেতা জোট এ্যাকর্ড এবং এ্যালায়েন্সের নানা কর্মকা-ে গত বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল তৈরি পোশাক খাত। রফতানির উলম্ফনে ৫ মাসে পোশাকে আয় এসেছে ১ হাজার ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ ডলার। প্রধান প্রধান সব বাজারে রফতানি বাড়ছে। ভারত, চীন, জাপানসহ অপ্রচলিত বাজারেও রফতানি বেড়েছে রেকর্ড হারে। রফতানি আয়ের সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকের আয়ও। ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ৫১ শতাংশ। বর্তমানে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি পাবেন ৮ হাজার টাকা। এদিকে মেয়াদ শেষেও অধিককাল বাংলাদেশে থাকার ইচ্ছায় পশ্চিমা উন্নয়ন অংশীদারদের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখা এবং বাংলাদেশ ছাড়তে উচ্চ আদালতের রায়- এমন অনেক কারণে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ইউরোপের ক্রেতাদের জোট এ্যাকর্ড অন ফায়ার এ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ বা এ্যাকর্ড। শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে জোটটির কঠোর অবস্থান ও সংস্কারে পিছিয়ে থাকা তিন শতাধিক কারখানা থেকে পোশাক না নিতে ক্রেতাদের কাছে চিঠি দেয়ার ঘটনা উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়ায়। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই পোশাক খাতে ভর করেই প্রতিমাসেই বাড়ছে পণ্য রফতানি। পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১ হাজার ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। একক মাস হিসেবে গত নবেম্বরে ৩৪২ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। গত পাঁচ মাসে নিটওয়্যার খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে ওভেন গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে ৬৮৮ কোটি ১ লাখ ডলার আয় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। প্রধান প্রধান সব বাজারে রফতানি বাড়ছে। ভারত, চীন, জাপানসহ অপ্রচলিত বাজারেও রফতানি বেড়েছে রেকর্ড হারে। ধারাবাহিক এই উন্নতির নেপথ্যে রয়েছে পোশাক খাতে গত ৫ বছর ধরে সংস্কারে নিরাপত্তা উন্নয়নের সুফল। দুই ক্রেতা জোট এ্যাকর্ড এবং এ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে বিশাল ব্যয়ের সংস্কারের ফলে বিদেশী ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। সংস্কার এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর ফলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ক্রেতারা ফিরেছে। বছরের শেষ দিকে এসে চীন-মার্কিন বাণিজ্যে শুল্ক লড়াই এই গতিতে নতুন শক্তি যুগিয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন বিশ্বের নিরাপদ কারখানার রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত ৫ বছরে পোশাক খাতে ব্যয়বহুল যে সংস্কার অগ্রগতি, তাতে নতুন ক্রেতাদেরও দৃষ্টি কেড়েছে। বিশ্বব্যাপী নিরাপদ পোশাক কারখানার রোল মডেল হিসেবে মজবুত অবস্থানে থেকে একটা ভাল বছর পার করেছে পোশাক খাত। একই কারণে আগামীতেও উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে আশা করেন তিনি। এদিকে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত নবেম্বরে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এই মজুরি গত ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করেছে পোশাক মালিকরা। ন্যূনতম মজুরির গেজেট অনুযায়ী, শ্রমিকদের জন্য সাতটি ও কর্মচারীদের জন্য চারটি গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা, এরমধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। অপরদিকে প্রথম গ্রেডে মজুরি ১৭ হাজার ৫১০ টাকা। শিক্ষানবিশ শ্রমিক মাসিক সর্বসাকূল্যে পাবেন ৫ হাজার ৯৭৫ টাকা। শিক্ষানবিশকাল হবে ৩ মাস। অপরদিকে পোশাক শিল্পের কর্মচারীদের চতুর্থ গ্রেডে ৮ হাজার ৩৭৫ টাকা ও প্রথম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫ টাকা। শিক্ষানবিশ কর্মচারী মাসিক সর্বসাকূল্যে পাবেন ৬ হাজার ১৬৪ টাকা। শিক্ষানবিশ কাল হবে ৬ মাস। পোশাক শ্রমিকরা দ্বিতীয় গ্রেডে ১৪ হাজারে ৬৩০ টাকা, তৃতীয় গ্রেডে ৯ হাজার ৫৯০ টাকা, চতুর্থ গ্রেডে ৯ হাজার ২৪৫ টাকা, পঞ্চম গ্রেডে ৮ হাজার ৮৫৫ টাকা ও ষষ্ঠ গ্রেডে ৮ হাজার ৪০৫ টাকা পাবেন। কর্মচারীরা দ্বিতীয় গ্রেডে ১১ হাজার ৩০০ টাকা ও তৃতীয় গ্রেডে ১০ হাজার ৭৭৫ টাকা ন্যূনতম মজুরি পাবেন। তবে সব গ্রেডেই মূল মজুরি ও বাড়ি ভাড়া ভাতা ছাড়াও ন্যূনতম মোট মজুরির মধ্যে ৬০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ৩৫০ টাকা যাতায়াত ভাতা ও ৯০০ টাকা খাদ্য ভাতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গেজেটে বলা হয়েছে, ন্যূনতম মজুরির কোন শ্রমিককে এই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেয়া যাবে না। তবে এই মজুরির চেয়ে বেশি হারে মজুরি দিলে তা কমানো যাবে না। শ্রমিকরা প্রতিবছর মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন, মালিকরা এই সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে বলেও গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অপর ক্রেতা জোট উত্তর আমেরিকার এ্যালায়েন্সের কর্মকা- ততটা আলোচনার জন্ম না দিলেও তাদের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে ভেতরে ভেতরে। সেফটি মনিটরিং অর্গানাইজেশন (এসএমও) এবং একাধিক বিকল্প প্লাটফর্ম গঠনের চেষ্টা করা হয়েছে জোটের পক্ষ থেকে। তবে শেষ পর্যন্ত বর্ধিত ছয় মাসের মেয়াদ শেষে গত সোমবার কার্যক্রম গুটানোর ঘোষণা বাস্তবায়নে উদ্যোক্তা এবং সরকারের প্রশংসা পেয়েছে এ্যালায়েন্স। দুই ক্রেতা জোটের বাইরেও শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের (ডিআইএফই) তত্ত্বাবধানে অসংগঠিত কারখানার সংস্কারে গতি বেড়েছে বিদায়ী বছরটিতে। গত কয়েক বছর ধরে অনুরোধ এবং সতর্ক করার পর বছরের শেষদিকে এসে এ বিষয়ে কঠোর হয় সরকার। সংস্কারে পিছিয়ে থাকা তিন শতাধিক কারখানার আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে অনুরোধ করে ডিআইএফই। তারা একই অনুরোধ করে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএকেও। দুই ক্রেতাজোটের মেয়াদ পরবর্তী সংস্কার চালিয়ে নিতে ডিআইএফইর নেতৃত্বে রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করা হয় বছরের প্রথমদিকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সহযোগিতায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এ্যাকর্ড এবং এ্যালায়েন্স। আরসিসির পূর্ণ সামর্থ্য বৃদ্ধির আগে কোন কারখানা হস্তান্তর করতে রাজি ছিল না ৃেকান জোট। তবে বছরের শেষদিকে এসে দুই কিস্তিতে ৮০টি কারখানা আরসিসির কাছে হস্তান্তর করেছে এ্যাকর্ড। তবে কৌশলে হস্তান্তর এড়িয়ে গেছে এ্যালায়েন্স।
×