ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিউজিক স্টুডিও এবি কিচেন... কিছু কথা কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

মিউজিক স্টুডিও এবি কিচেন... কিছু কথা কিছু স্মৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ বেশ উত্তেজিত হয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিন, কী নিয়ে আজ আর মনে নেই, ছিলেন মুখভার করে। এটা ওটা ছুঁড়ে মারছিলেন। ২০০০ অথবা ২০০১ সালের কথা। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের শীর্ষ তারকা তিনি। তুমুল জনপ্রিয় দল এলআরবি’র প্রধান। ভোকালিস্ট। লিড গিটারিস্ট। বিশাল খোলা মঞ্চে সামনে দাঁড়িয়ে গিটার হাতে গান করেন। শ্রোতাও তার সঙ্গে গায়, দোলে। রাস্তায় শপিংমলে দু’মিনিট দাঁড়ালে জায়গাটি ছোটখাটো জনসভায় রূপ নেয়। তখন অটোগ্রাফের যুগ ছিল। ভক্ত অনুরাগীরা ঘিরে ধরেন, অটোগ্রাফ চান। খ্যাতির কত যে বিড়ম্বনা। সব সহ্য করতে হচ্ছিল তাকে। এ অবস্থায় কখনও সখনও বিরক্ত হয়ে যাওয়া, মেজাজ হারানো অস্বাভাবিক নয়। এর পরও আমি কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। সহজ অনুমানটি এই ছিল যে, অনেকের মতো আইয়ুব বাচ্চুরও বাইরে কোমল। ভেতরে রুক্ষ শুষ্ক একটা মন। এত চমৎকার আবেগী যার সুর, এত মেলোডি যার কণ্ঠে তাঁর কাছ থেকে আমার ওইরকম কিছুই প্রত্যাশা ছিল। সেদিনের আলাপচারিতা আমার দিক থেকে তাই খুব বেশি জমেনি। কোনরকমে কথা শেষ করে ‘এবি কিচেন’ ছেড়ে আসি। ধরেই নিয়েছিলাম, আর এবি কিচেনে যাওয়া হবে না। কিন্তু ঘটল উল্টো। তাকে নিয়ে আমার প্রথম লেখাটি খুব যে দাঁড়িয়েছিলÑ তা নয়। তিনি তবু মুগ্ধ হয়েছিলেন, অনুমান করি। আমার মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও সেদিন তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। ফোনে সে কথা জানিয়েছিলেন। আবারও এবি কিচেনে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল তার পক্ষ থেকে। বলাটা এত আন্তরিক ছিল যে, যেতে হয়েছিল কিচেনে। তার পর ওখানে যত গিয়েছি ততই ভুল ভেঙ্গেছে। ততই আবিষ্কার করেছি আইয়ুব বাচ্চুকে। মূলত এবি কিচেনেই সবচেয়ে বেশি আপন সবচেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে ধরা দিতেন ব্যান্ড লিজেন্ড। হ্যাঁ, এবি মানে আইয়ুব বাচ্চু। এবি কিচেন মানে আইয়ুব বাচ্চুর রান্নাঘর। মগবাজার কাজী অফিসের গলিতে নির্মিত রান্নাঘরে, ঠিক রান্না নয়, আসলে মিউজিক হতো। তৈরি হতো নতুন নতুন গানের কথা ও সুর। কম্পোজিশনের কাজ হতো। ব্যান্ডের সদস্যরা একসঙ্গে বাজাতেন। শরীরের ঘাম ঝরাতেন। লম্বা সময় ধরে চলত প্র্যাকটিস। দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটাতেন আইয়ুব বাচ্চু। তাকে ঘিরে চলতো দীর্ঘ আড্ডা। জনপ্রিয় গায়করা আসতেন। সুরকার গীতিকাররা আসতেন। আসা যাওয়া চলত সাংবাদিকদের। সাক্ষাতকার, চলমান ইস্যুতে মন্তব্য সবই এখান থেকে। নতুন যে গানটি হলো, কেমন হলো? কতটা গ্রহণ করবেন শ্রোতা? উত্তর জানতে গানটি এখানে প্রথম শোনানো হতো। এভাবে স্টুডিওটি শুধু আইয়ুব বাচ্চুর বা এলআরবির নয়, সবার সকলের হয়ে উঠেছিল। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল এবি কিচেন। এখানেই আমি ক্রমে আবিষ্কার করেছি প্রথম দেখার শতভাগ বিপরীত মানুষটিকে। ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর ভেতরে যে আসলে শিশু বাস করে, তিনি যে ভারি আবেগী একজন মানুষ, আমার তা জানা হয় এবি কিচেনে গিয়েই। অনেকে জানেন, এই শিশুটি মাকে ভীষণ ভালবাসত। সেদিনের গল্পটা বলিÑ বিকেলে এবি কিচেনে ঢুকেই সব কেমন থমকে আছে বলে মনে হলো। বাচ্চু ভাইয়ের মন যারপরনাই বিষণœ। কেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, মায়ের শরীরটা ভাল না। মা...। কথা শেষ করতে পারলেন না। দেখলাম চোখ ভিজে উঠেছে। ছোট ছেলেটির মতো কেঁদে ফেললেন তিনি। মায়ের জন্য যেমন, ঠিক তেমনই প্রেম ছিল সঙ্গীতের জন্য। একইদিন একটু পরেই ওপেন এয়ার কনসার্ট। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে হাজার হাজার শ্রোতা অপেক্ষা করে আছে। এলআরবি আসছে। আইয়ুব বাচ্চু গাইবেন। চোখের জল তাই আঙুল দিয়ে মুছে নিলেন। অত্যন্ত প্রফেশনাল শিল্পী হাতে তুলে নিলেন তার ‘রুপালি গিটার।’ এবি কিচেন থেকে গাড়ি এগিয়ে চললো আর্মি স্টেডিয়ামের দিকে। পথে বার বারই ফোন। মায়ের খোঁজ চলছিল। মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ হচ্ছিল। আর ভক্ত অনুরাগীদের দেখে অর্জন করছিলেন শক্তি। পুরোটা সময় দারুণ মাতিয়ে রাখলেন তিনি। গাইলেনÑ হাসতে দেখ গাইতে দেখ/অনেক কথা মুখর আমায় দেখ/দেখ নাকো হাসি শেষে নীরবতা...! এভাবে গাইতে গাইতেই, কষ্ট আড়াল করতে করতেই মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন। যদি সেটি সম্ভব না হয় তবে শেষদিন পর্যন্ত গিটার বাজাবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। বিশ্ববিখ্যাত তারকা জো স্যাট্রিয়ানির ভক্ত। বলতেন, তার মতো বাজিয়ে যাব। থামা যাবে না। কিন্তু থামলেন তিনি। ‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে...।’ সুদূর নীলিমায় উড়াল দিয়েছেন এবি। একবার এক অনুষ্ঠানে গাইছিলেন তিনি। বড়লোক বাড়ি। পারিবারিক অনুষ্ঠান। এ ধরনের আয়োজনে সাধারণত অংশ নেন না। আমাদের কয়েকজনের অনুরোধ রাখতেই অনুষ্ঠানে গাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এখানেই ঘটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি। বিশাল বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় মঞ্চ গড়া হয়েছিল। মঞ্চে গাইছিল এলআরবি। একটির পর একটি গান গাইছেন আইয়ুব বাচ্চু। শ্রোতারাও মন্ত্রমুগ্ধ। ঠিক তখন বাসার ওপর থেকে একদল তরুণ নেমে এলেন। মঞ্চের ঠিক সামনে হাত তুলে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেÑ স্টপ স্টপ! এভাবে সঙ্গীত থামিয়ে দেয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। কল্পনার অতীত। আইয়ুব বাচ্চু মাঝপথে গান থামালেন। পরে জানা গেল, ওপর থেকে কনের নেমে আসার সময় হয়েছে। এখন পূর্ব নির্ধারিত হিন্দি গান হবে। সে জন্য এলআরবিকে মঞ্চ ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোন মুখে বাচ্চু ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো? কিছু সময় এদিক ওদিক করে তার কাছে গেলাম। যেতে হলো। ভীষণ আবেগী মানুষটির চোখ যথারীতি ভেজা। অসম্মানিত বোধ করছিলেন। কিন্তু বুঝতে দিতে চাচ্ছিলেন না। কষ্ট গোপন করে আমার পীঠে হাত রাখলেন। উল্টো সান্ত¦না দিয়ে বললেন, কিছু না। ভুলে গেলেই হলো। ও কিছু না। কত কিছুই তো হয়ে যায়। আসলেই কত কিছু হয়ে যায়! হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে আইয়ুব বাচ্চু চলে গেলেন। এই চলে যাওয়া তো আসলে নিজের ইচ্ছায় নয়। হয়ে যায়! আইয়ুব বাচ্চু অনেক বড় তারকা ছিলেন। কিন্তু কোন অহঙ্কার ছিল না। বিশালদেহী মানুষটার বুক তারও বেশি বড় ছিল। দেখা হলে প্রথমেই বুকে জড়িয়ে ধরতেন। চাপড়ে দিতেন। এই বন্ধুতা এই সুহৃদের মতো কাছে টানার শক্তি ক’জনের থাকে? এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। কোন একদিনের কথা, কনসার্টে অংশ নিতে একটু পরেই বের হবেন এবি কিচেন থেকে। হাতে তেমন সময় নেই। বেশ তাড়াহুড়া। দ্রুত অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছতে হবে। এদিকে পেটে ক্ষুধা। খাওয়া হয়নি। এ অবস্থায় একটি প্লেটে খাবার দেয়া হলো তাকে। আরেকটি প্লেট খোঁজা হচ্ছে আমার জন্য। কিন্তু থামিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, আমার প্লেট থেকে খা। বলতে বলতেই ভাত দুইভাগ করলেন। আমার দিকে একভাগ ঠেলে দিয়ে বললেন, শুরু কর। সঙ্গীত অনুরাগী সংবাদকর্মীর জন্য এর চেয়ে আবেগঘন স্মৃতি আর কী হতে পারে? আইয়ুব বাচ্চুর কিচেনটি ছিল অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পীদের বড় আশ্রয়। প্রতিশ্রুতিশীল কত শিল্পী যে এখানে সকাল থেকে রাত অবদি কাটিয়েছেন! না, গুনে শেষ করা যাবে না। নতুনদের জন্য গান করেছেন তিনি। টেলিভিশনে পত্রিকায় ফোন করে বলে দিয়েছেন সহায়তা করতে। এভাবে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কাছে প্রিয় ‘বস’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমিও ‘বস’ বা ‘বাচ্চু ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। কী বলব? কীভাবে বললে বোঝানো যাবে যে, এই ‘বস’ শব্দটি মন থেকে এসেছে। এই ‘বাচ্চু ভাই’ শুধু ডাকার জন্য ডাকিনি। কাকে বলব? এবি কিচেনে আর যাওয়া হবে না। হবে না যে, এই বেদনা শেয়ার করব কার সঙ্গে?
×