ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মন্দির মণ্ডপ ঘিরে অসাম্প্রদায়িক উৎসব

লোক ঐতিহ্যের মেলা নাটক যাত্রাপালাসহ বর্ণাঢ্য আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

লোক ঐতিহ্যের মেলা নাটক যাত্রাপালাসহ বর্ণাঢ্য আয়োজন

মোরসালিন মিজান ॥ উৎসব চলছে। এখন সন্ধ্যা, মানে অন্ধকার নয়; আলোঝলমলে শহর। মণ্ডপে মণ্ডপে মরিচবাতি। প্রধান প্রধান রাস্তায়, গলির মুখে সুসজ্জিত তোরণ। দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মন্দিরগুলোতে দেবী দর্শনের সুযোগ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লোক ঐতিহ্যের মেলা। এসব কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নয় শুধু, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও উৎসবে যোগ দিচ্ছেন। ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন আনন্দ। অসাম্প্রদায়িক বাংলা মায়ের এই রূপ নতুন করে আশাবাদী করে। এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। বরাবরের মতো এবারও ঢাকার সব মন্দিরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। নির্মাণ করা হয়েছে অনেক অস্থায়ী ম-প। ম-পগুলোর কয়েকটি দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মন্দিরের আদলে গড়া হয়েছে। কিছু আবার স্বতন্ত্র নির্মাণশৈলীর। প্রতিমা গড়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন থিম চিন্তা করা হয়েছে। ফলে এক মন্দিরে আটকে থাকছেন না কেউ। এ মন্দির ও মন্দির ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সোমবার ছিল মহাষষ্ঠী। এদিন থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হয় দুর্গোৎসবের। মঙ্গলবার মহাসপ্তমীর দিনে ম-পগুলোতে ভিড় আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। পূজা তো চলছেই। পাশাপাশি মন্দির ও ম-পগুলো ঘিরে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ফলে ধর্মীয় আচারের বাইরেও উৎসবের একটা আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে। গত দু’দিন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের এলাকায় নানা পণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে। এখানে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্পের নিদর্শন। নাড়িকেলের নাড়ু, মোয়া, বাতাসার মতো বাঙালী ঐতিহ্যের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভিড় ঠেলে দোকানগুলোতে পৌঁছতে হচ্ছিল। দেবী দর্শন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন বিকাশ ও সেজুতি দম্পতি। কথা প্রসঙ্গে সেজুতি বললেন, ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকেই দেবী দর্শন শুরু হয় আমাদের। তবে মন্দিরের ভেতরে খুব বেশি সময় থাকা হয় না। মেলার টানে বাইরে চলে আসি। এখানেই বেশি সময় কাটে। বিকাশ বলেন, মেলা ঘুরে নারিকেলের নাড়ু আর মিষ্টি কিনেছি। এগুলো সাধারণত দোকানে পাওয়া যায় না। মেলার পরিবেশটাও খুব উপভোগ করেন বলে জানান তিনি। সাম্প্রতিককালে বনানী পূজা ম-প বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। অভিজাত এলাকার একটি মাঠে এবারও নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল মণ্ডপ। এর নির্মাণশৈলী সত্যি তাকিয়ে দেখার মতো। দুর্গোৎসবের আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিল্লীর আলোচিত লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের আদলে মণ্ডপটি গড়া হয়েছে। ১৯৩৭ সালে নির্মিত ওই মন্দিরে সব ধর্মের মানুষের প্রবেশকে স্বাগত জানানো হয়। সেই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবকে সবার সামনে তুলে ধরতেই বনানীর ম-পটি গড়া হয়েছে। হয়ত তাই এখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের বড় স্রোতটি দৃশ্যমান হচ্ছে। ম-পের পাশেই মঞ্চ। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভক্তিমূলক গান, লোকগীতি ইত্যাদি পরিবেশন করছেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। থাকছে নাট্যায়োজন। বাদ যাচ্ছে না কবিতাও। চলছে চমৎকার আবৃত্তি। আয়োজন করা হচ্ছে আকর্ষণীয় আরতি প্রতিযোগিতার। এখানেই শেষ নয়, নবমীর দিন আসছেন ভারতীয় শিল্পী অদিতি মুন্সি। কীর্তন শোনাবেন তিনি। এর বাইরে মন্দির ঘিরে আছে ২২ টি স্টল। স্টলগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, পূজার সামগ্রী ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। মঙ্গলবার এখানে কথা হয় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, প্রতিবছর পূজায় বনানী মাঠে আসি। ম-প ঘিরে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুন্দর একটা প্রকাশ ঘটে। দেখে কী যে ভাল লাগে! মেয়ের আগ্রহে স্টল ঘুরে কেনাকাটা করেছেন বলেও জানান তিনি। রাজারবাগের বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে আবার চলছে শারদীয় নাট্যোৎসব। মঙ্গলবার ছিল বিশেষ আয়োজন। এদিন সন্ধ্যায় ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা পরিবেশন করে দেশ অপেরা। পালার শিরোনামÑসতী করুণাময়ী। শহর ঢাকায় যাত্রাপালা দেখার সুযোগ কই? পূজায় এমন পরিবেশনা তাই এক রকম লুফে নেন দর্শক। যাত্রাপালার পালাকার ছিলেন ব্রজেন্দ কুমার দে। নিদের্শনায় ছিলেন যাত্রাঅন্তপ্রাণ মিলন কান্তি দে। এসবের বাইরে আলাদা করে বলতে হয় শাঁখারীবাজারের পূজার কথা। বহু বছর ধরে এখানে শাঁখারীরা বাস করছেন। ঐতিহ্যবাহী শাঁখা ও শঙ্খ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারা। পাশাপাশি প্রতিমা সাজানো ও পূজার সামগ্রী পাওয়া যায়। ফলে সব সময়ই জমজমাট থাকে। আর এখন পূজার সময়। আনন্দ আর ধরে না। ছোট জায়গায় ১০টির মতো ম-প। সব ঘুরে দেখে তবেই ভ্রমণ শেষ করছেন দর্শনার্থীরা। চলছে কেনাকাটাও। এখানেও সব ধর্মের মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে ঐতিহ্যপ্রেমীরা ছুটে আসছেন। মঙ্গলবার অনেক রাতে সেখানে গিয়ে মনে হয়, দিনের মতো সরগরম। কত যে চেনা মুখ। কেউ পরিবার পরিজনসহ এসেছিলেন। কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে। বস্তুত সারা ঢাকার ছবিটাই এমন। আনন্দঘন। মন্দির ঘিরে এই উৎসব চলবে দশমীর দিন পর্যন্ত।
×