ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে কাজে যোগদান

ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের কর্মবিরতি, বিমানের সিডিউল বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১ অক্টোবর ২০১৮

  ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের কর্মবিরতি, বিমানের সিডিউল বিপর্যয়

আজাদ সোলায়মান ॥ বারবার আশ্বাসের পরও চাকরি স্থায়ী না করায় বিক্ষুব্ধ ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে বিমানের গ্রাহক সেবা। এতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বিলম্ব হয়। রবিবার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করে সিভিল এভিয়েশন। একই অবস্থা ছিল চট্টগ্রামের শাহ আমানতে। সেখানেও পরিস্থিতি সামাল দেয় সিভিল এভিয়েশন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে টনক নড়ে বিমান কর্তৃপক্ষের। অবশেষে বেলা তিনটায় বিমানের সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানের সঙ্গে দাবি মানার আশ্বাস দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছান ক্যাপ্টেন এ এম মোসাদ্দেক আহমেদ। শ্রমিকদের তিনি ঘোষণা দেন, আগামী বোর্ড মিটিংয়ে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করার বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।’ অন্যদিকে বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মশিকুর রহমান পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, আগামী বোর্ড মিটিংয়ে যদি দাবি আদায় না হয়, তবে আমরা আবার কর্মবিরতিতে যাব। উভয়পক্ষের ঘোষণার পর বিকেল চারটা থেকে ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে শুরু করে। রবিবারের এ আকস্মিক কর্মবিরতির দায় নিতে চায়নি কোন পক্ষই। শ্রমিকরা বলছেন, বিমানমন্ত্রী দু’দিনের সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর কোন সাড়া মিলেনি। সেজন্যই ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাপের মুখে কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীর সেবা কিছুটা বিঘিœত হয়েছে। এজন্য শ্রমিকরা নয়, ম্যানেজমেন্ট দায়ী। রবিবার সকাল আটটায় পালাবদলের সময় দেখা যায়, শাহজালালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও বিএফসিসিতে ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী এডমিন ভবনের গেটে জড়ো হতে থাকে। এ দুটো শাখার মোট শ্রমিকের ৮০ ভাগই ক্যাজুয়াল হওয়ায় ফাঁকা হয়ে পড়ে তাদের কর্মস্থল। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক একযোগে প্রথমে যায় বিমান শ্রমিকলীগ ও সিবিএ অফিসে। সেখানে সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানকে পেয়ে তাকে ঘেরাও করে শ্রমিকরা। এখানে অস্থায়ী শ্রমিকদের নেতা মোহাম্মদ হানিফ ঘোষণা দেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করব। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বলাকা ভবন ঘেরাও করব। ন্যায্য দাবি আদায়ের কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাব। মশিকুর রহমান ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে বিমানবন্দর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ সেখানে হাজির হয়ে তাকে উদ্ধার করেন। এরপর হানিফের নেতৃত্বে একটি মিছিল সিবিএ কার্যালয় থেকে বিক্ষোভ শুরু করে বলাকা ভবনের সামনে এসে অবস্থান নেয়। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবে বলে ঘোষণা দেন। এদিকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সব ক্যাজুয়াল শ্রমিক বিমানবন্দরের কর্মস্থল ছেড়ে বলাকায় কর্মসূচীতে যোগ দেয়ায় ভেঙ্গে পড়ে বিমানের গ্রাহক সেবা। বিপর্যয় দেখা দেয় ফ্লাইট সিডিউলে। হাতে গোনা ২০/২৫ স্থায়ী কর্মচারী অসহায় হয়ে চেকইন কাউন্টার, বেল্ট এরিয়া ও এ্যাপ্রোন এলাকায় দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে। তারা কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে যাত্রীদের হৈচৈ ও বিশৃঙ্খলা। দীর্ঘক্ষণ চেকইন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও তারা সেবা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। একইভাবে নিচে কনভেয় বেল্ট এরিয়ায় কয়েক শ’ যাত্রীর লাগেজ না আসায় তারা মারমুখী হয়ে উঠেন। এমন এক জটিল অবস্থায় খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক বিষয়টি সিভিল এভিয়েশনের সদর দফতরে অবহিত করেন বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রæপ ক্যাপ্টেন ফারুক আব্দুল্লাহ। খবর পেয়ে মুহূর্তেই শাহাজালালে ছুটে আসেন সিভিল এভিয়েশন সদস্য এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি অচলাবস্থা নিরসনে বিমানবন্দরে কর্মরত এভসেক, এপিবিএন, আনসার সদস্যদের জরুরী নির্দেশনা দেন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজে যোগ দিতে। বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে তিনি বিমানবন্দরের সব অপারেশনাল কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজেই তদারকি করতে থাকেন। দুপুর সাড়ে বারোটায় এ্যাপ্রোন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পরিচালক গ্রæপ ক্যাপ্টেন ফারুক আবদুল্লাহ, উইং কমান্ডার নুর ই আলম সিদ্দিকী ও উপ-পরিচালক বেনীমাধব বিশ্বাসের উপস্থিতিতে ৬০/৭০ নিরাপত্তাকর্মী এরাইভাল লাগেজের কাজে ব্যস্ত। প্রতি ফ্লাইট অবতরণের সঙ্গে সেখানে ছুটে যান এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। খোলা আকাশের নিচে তপ্তরোদে দাঁড়িয়ে তাকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় প্রতি ফ্লাইটের কাছে গিয়ে লাগেজ বাকেট লোড আনলোডের কাজ তদারকি করতে দেখা যায়। টানা ৬ ঘণ্টা তাকে সেখানে কর্মীদের নিয়ে কাজের সমন্বয় করতে দেখা গেছে। এখানে উপস্থিত বেনীমাধব বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করছি। ৭৭৭ উড়োজাহাজের লাগেজগুলো সব ডেলিভারি দিয়েছি। বিমানের একজন শ্রমিকও নেই। তাদের কাজটা আমরা আরও দক্ষতা ও বিশ্বতার সঙ্গে করছি। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, এমন পরিস্থিতিতেও বিমানের কোন উর্ধতন কর্মকর্তাকে শাহাজালালে উপস্থিত না দেখে। কোন পরিস্থিতিতে আপনারা বিমানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন জানতে চাইলে বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রæপ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লহ আল ফারুক বলেন, বিমানের লোকজন কর্মবিরতি পালন করায় আমরা সিভিল এভিয়েশনের লোকবল দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আনসার, এভসেক সদস্যদের দিয়ে ফ্লাইটের কাজ করানো হচ্ছে, যাতে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে না হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস দেয়। বেশিরভাগ ক্যাজুয়াল শ্রমিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসে কাজ করে। তারা কর্মবিরতি দিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়ায় এই সিডিউল বিপর্যয় ঘটে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ দায়িত্ব পাালন করতে হবে। এ সময় সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে ফ্লাইট সিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিঙ্গাপুরগামী বিজি-০৮৪ ফ্লাইটটি সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, সেটি সকাল ৯টা ৪ মিনিটের দিকে ছেড়ে যায়। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের কুয়ালালামপুরগামী বিএস-৩১৫ ফ্লাইটটি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ছেড়ে যায় ৯টা ১০ মিনিটে। এয়ার এরাবিয়ার শারজাহগামী জি-৯৫১৮ ফ্লাইটটি সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছেড়ে যায় সকাল ১০টার দিকে। এমিরেটসের দুবাইগামী ইকে-৫৮৩ ফ্লাইটটি ১০টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার করা থাকলেও ১১টা ৩২ মিনিটে ছেড়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটগুলো নির্ধারিত সময় ছাড়তে পারেনি। এ সময় বিমানের জিএম নুুরুল ইসলাম হাওলাদার ও জিএম কাস্টমার সার্ভিস আতিক সোবহান ছাড়া বিমানের অন্য কোন কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরে সঙ্কট নিরসনে তৎপর থাকতে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, সকালের শুরুর দিকে কয়েকটি ফ্লাইটে সিডিউল বিপর্যয় ছিল। ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা না থাকলেও এপিবিএন দিয়ে কাজ করেছি। দুপুরের পর সিভিল এভিয়েশনও যোগ দেয়। এদিকে শ্রমিকদের বলাকা ভবন ঘেরাওয়ের মুখে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমেদ, সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান ও ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফকে নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসেন। ত্রিপক্ষীয় আলোচনার সময় এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ কথা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের উর্ধতন কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে পরামর্শের পর মোসাদ্দিক জানান, পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। তখন মশিকুর রহমান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি আগামী বোর্ড মিটিংয়ে যদি দাবি না আদায় হয়, তবে আমরা আবার কর্মবিরতিতে যাব। কারণ আজকের ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের সঙ্গে সিবিএ অংশ নেয়নি। যুগ যুগ ধরে সুবিধাবঞ্চিত দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিকরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর এ ধরনের কর্মসূচী দিতে বাধ্য হয়েছে। যদি আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না দেয়া হয়, তাহলে পরবর্তী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে সিবিএ। উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিমানের ৭০০ ক্যাজুয়াল পে-গ্রুপ (৩১) ও (৩২) তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা চাকরি স্থায়ীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তাতে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের (পে-গ্রুপ ১) ১৮০০ জনের চাকরি স্থায়ী করার কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা ২৪ সেপ্টেম্বর বিমান ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তখন বিমানমন্ত্রী দু’দিনের সময় চেয়ে আশ্বাস দেন-দাবি না মানা হলে এ শ্রমিকদের আন্দোলনে তিনিও সমর্থন দেবেন। কিন্তু তিনিও কিছু করেননি। জানা গেছে, বিমান শ্রমিক লীগ (সিবিএ) ২০০৯ সাল থেকে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। ইতোমধ্যে আরও কয়েকবার আলোচনার কথা বলে এভাবে শ্রমিকদের আন্দোলন ঠেকিয়েছে বিমান প্রশাসন। এ নিয়ে এর আগেও দাবি আদায়ে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ ছাড়াও বিমানবন্দরে ধর্মঘটও করে সংগঠনটি। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আল্টিমেটাম দেয় বিমান শ্রমিক লীগ। ওইদিন বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনে আয়োজিত সমাবেশে সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চাকরি স্থায়ী না করলে আন্দোলনে যাওয়ার ডাক দেন। পরবর্তী সময়ে বিমান ম্যানেজমেন্টের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করে সিবিএ। এরপর দ্বিতীয় দফা শুরু হয় অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে ক্যাজুয়ালদের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায়।
×