ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তুরস্কের অর্থনীতিতে ঝড়ের কালো মেঘ

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

তুরস্কের অর্থনীতিতে ঝড়ের কালো মেঘ

একটা সময় ছিল যখন ভাবা হতো যে ধর্মনিরপেক্ষ, বিত্তশালী তুরস্ক শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হবে এবং পাশ্চাত্যের পরিচিতি ধনী উদারপন্থী দেশগুলোর কাতারে স্থান করে নেবে। কয়েক বছর আগেও তুরস্ক উদীয়মান বাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল অতি পছন্দের দেশ। কিন্তু সেই দিন বেশ আগেই গত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তুরস্ক কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে পাশ্চাত্যে থেকে সরে আসছে। অধিক থেকে অধিকতর ইসলামপন্থী হয়ে উঠছে দেশটি। ন্যাটোর সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়ছে এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বাধীন কার্যত এক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে গোড়ামির জন্য দেশটিকে মূল্য দিতে হচ্ছে। দেশটিতে প্রবৃদ্ধির যে উচ্চহার রয়েছে তা নির্ভর করেছে বৈদেশিক ঋণের ওপর। বৈদেশিক মুদ্রায় কপোরেট ঋণের পরিমাণ ২০০৯ সালের পর থেকে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এরদোগান বিশ্বাস করেন যে সুদের উচ্চহার মুদ্রাস্ফীতি নিরাময় করার পরিবর্তে বরং মুদ্রাস্ফীতির কারণ ঘটায়। সেই এরদোগানই আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সুবিবেচনা প্রসূতভাবে কাজ করার নির্দেশ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এসবের পরিণতিতে তুরস্ক এখন মুদ্রাসঙ্কটকবলিত হয়েছে। এই সঙ্কট অবশ্য অংশত ত্বরান্বিত হয়েছে দেশটির ওপর আমেরিকার অবরোধ আরোপের কারণে। এন্ড্রু ব্রুনসন নামে এক পাদ্রিকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। তাঁকে মুক্তি দিতে এরদোগানের অস্বীকৃতির কারণে আমেরিকা ঐ বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তুরস্কের ধাতব সামগ্রীর ওপর আরও চড়া শুল্ক আরোপের অঙ্গীকার ঘোষণা করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আগস্ট মাসে তুর্কী মুদ্রা লিরার মূল্যমান এক-তৃতীয়ংশ হ্রাস পায়। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায় এবং তুরস্কের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাবলীলতার ওপর হুমকির সৃষ্টি হয়। ওদিকে আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক বিষিয়ে উঠেছে। এরদোগান তুরস্কের অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর জন্য বিদেশী শত্রুদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন এবং আমেরিকার গাড়ি, এলকোহল ও কসমেটিক্সের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছেন। এই সঙ্কট তুরস্কের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকে নার্ভাস বোধ করছে। তাদের কেউ কেউ পাততাড়ি গুটানোর কথা ভাবছে। তুরস্কের সমস্যার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত সঞ্চয় হার, চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রায় বিপুল অঙ্কের ঋণ এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। এগুলো তুর্কী অর্থনীতিকে ভঙ্গুর প্রায় করে তুলেছে। সরকার বিমানবন্দরের মতো বিশাল বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পে এবং কৃষ্ণ সাগর ও মারমারা সাগরের মধ্যে সংযোগ সাধনের জন্য ১৩শ’ কোটি ডলার ব্যয়ে ২৮ মাইল দীর্ঘ খাল খননে বিপুল অর্থ ঋণ করায় সরকারের ঘাড়ে বৈদেশিক ঋণের বোঝা চেপে বসেছে। এই সমস্যা মোকাবেলায় তুরস্ক এ পর্যন্ত তেমন কিছুই করেনি। তবে কাতারের মতো মিত্র দেশগুলোর বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেশ ঢাক ঢোল পিটাচ্ছে। এই দেশগুলো হয়ত ডলার বিনিয়োগ করবে তবে বিশ্বাসযোগ্যতা নয়। সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে এরদোগান আমেরিকাকে দায়ী করছেন। তা তিনি করতে পারেন। তবে তাঁর স্বৈরাচারী পদ্ধতি কূটনীতিকে লালিত করে চলেছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারত সেগুলোকে তিনি নিবীর্য করে ফেলেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত যেখানে স্বাধীন ভূমিকা পালন করে চলা সেখানে সেটি এরদোগানকে খুশি করতে উদ্ভট সব পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে এরদোগানেরই এক জামাতা। প্রেসিডেন্টের ভুলত্রুটি যাদের দেখিয়ে দেয়ার কথা সেই মিডিয়া এতই বশীভূত যে তারা সমালোচনা করার পরিবর্তে এরদোগানের সুরে সুর মিলিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করছে। প্রকৃত সংবাদ জানতে না পেরে তুর্কীদের অনেকে বিশ্বাস করছে তাদের অর্থনৈতিক দুর্গতির জন্য পশ্চিমীরাই দায়ী। তাঁর ক্ষমতা খর্ব করার কেউ না থাকায় এরদোগান উত্তরোত্তর তার ঘৃণ্য স্বৈরাচারী স্বরূপ উন্মোচন করছেন। স্বাভাবিক সময় হলে তুরস্কের পশ্চিমী মিত্ররা এরদোগানকে পথ পরিবর্তন করতে বলতেন। কিন্তু তারা তাকে কোনভাবে ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছেন না। পাছে তিনি সিরীয় উদ্বাস্তুদের বানের স্রোতের মতো ইউরোপে যাওয়ার পথ খুলে দেন। ওদিকে ট্রাম্প ও এরদোগানের উদ্দেশে যেভাবে তর্জন গর্জন করে চলেছেন তুর্কী নেতাও পাল্টা হুমকি দিতে ছাড়ছেন না। পাছে অন্যরা দুর্বলভাবে এই চিন্তা থেকে কেউই পিছু হটতে নারাজ। অচিরেই তুর্কী জনগণকে আরও বা সঙ্কটে ভুগতে হবে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×