ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে টিকফা বৈঠক

অবকাঠামো খাতে যুুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগ চাইবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩০ আগস্ট ২০১৮

অবকাঠামো খাতে যুুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগ চাইবে বাংলাদেশ

এম শাহজাহান ॥ টিকফা ফোরামের চতুর্থ বৈঠকে এবার অবকাঠামো খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ চাইবে বাংলাদেশ। অপরদিকে, বাংলাদেশের তুলার বড় বাজার ধরতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এদেশের গার্মেন্টস খাতে বিপুল পরিমাণ তুলার প্রয়োজন হয়, যার বেশির ভাগ আমদানি হয় ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তুলার এই বড় বাজার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। আর তাই টিকফায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে তুলা রফতানি প্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানাবে। তৈরি পোশাকের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। তবে জিএসপির বিষয়ে কোন আলোচনা করা হচ্ছে না। জানা গেছে, টিকফা ফোরামের চতুর্থ এই বৈঠকটি আগামী ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর ওয়াসিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই বৈঠকে যোগদান পরবর্তী বক্তব্য উপস্থাপনে বাংলাদেশ পক্ষের এজেন্ডা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসুর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল এবারের সভায় যোগ দিতে যাচ্ছেন। টিকফা বৈঠক ঘিরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া স্টেক হোল্ডারদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত নেয়া হয়। পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ গার্মেন্টস পণ্যের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করাসহ পোশাকের দাম বাড়ানোর মতামত দিয়েছে। এর আগে গত বছর ঢাকায় ফোরামের তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাসটেইনেবল কম্প্যাক্ট ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালু এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির ওপর তাগিদ দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এই চুক্তির আওতায় দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে মার্কিন বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মোঃ মুনীর চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, টিকফা ফোরামের এবারের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা হবে। শুধু তাই নয়, পোশাকের সঠিক দাম যাতে নিশ্চিত হয় সে বিষয়টি নিয়েও টিকফা বৈঠকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এখন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পোশাক বিক্রি হয়ে থাকে। তাই দেশটির সঙ্গে আলোচনার মতো অনেক বিষয় আছে। তিনি বলেন, রফতানিতে শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যা রয়েছে। এসব বাধা দূর হওয়া প্রয়োজন। টিকফা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকবে দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয় (ইউএসটিআর)। প্রসঙ্গত, টিকফার আগে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি (টিফা) নামে ২০০৩ সাল থেকেই বাংলাদেশকে একটি চুক্তি সইয়ের তাগিদ দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে কিছু বিষয় পরিবর্তন করে টিফা থেকে করা হয় টিকফা। টিকফা সই হয় ২০১৩ সালের ২৫ নবেম্বর। এ ফোরামের বছরে কমপক্ষে একবার বৈঠক করার কথা রয়েছে। মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব ॥ টিকফা চুক্তি কার্যকরে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হবে। এছাড়া প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ রফতানি বাণিজ্য এগিয়ে নিতে চায় বাংলাদেশ। উদ্যোক্তারা বলছেন, পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশ কখনও লাভবান হতে পারেনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছেÑতৈরি পোশাক। চীন-জাপানের পর অর্থনীতির পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চান। এক্ষেত্রে বিদ্যুত ও জ্বালানি, গ্যাস উত্তোলন, জাহাজ নির্মাণ, রিসাইক্লিং, রাসায়নিক সার, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধশিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটজাত পণ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, পর্যটন, চিকিৎসা উপকরণ ও টেলিযোগাযোগ খাত নিয়ে মার্কিন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ মাত্র সাড়ে চার শ’ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার যা সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাত ছাড়াও আরও বেশকিছু খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহজ কর অবকাশ সুবিধা, কম শুল্কে যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য শতভাগ সমান সুবিধা, বাধাহীন এক্সিট পলিসি, মুনাফা নিজ দেশে নেয়াসহ নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৮ কোটি তরুণ জনশক্তি এবং ১৬ কোটি ক্রেতার বিশাল বাজার বিনিয়োগকারীদের সহায়ক হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তির (টিকফা) ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ॥ এবারের টিকফা ফোরামের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে প্রথমেই আছে মার্কেট এ্যাকসেস বা বাজার প্রবেশসংক্রান্ত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তুলা রফতানির সুবিধার্থে দেশটি এখানে আমদানিকৃত তুলা পরীক্ষার শর্ত শিথিলের প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে আমদানিকৃত মার্কিন তুলায় জীবাণু সংক্রমণের বিষয়ে দুই ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এ পরীক্ষার ধাপ কম দেখতে চায়। এছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপিত কর্পোরেট কর হারও অনেক বেশি বলে মনে করছে দেশটি। এ কর কমানোর বিষয়েও আলোচনা করতে চায় তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পদ্ধতি চালুর সুযোগ দেখতে চায়। এ নিয়েও কথা বলতে আগ্রহী মার্কিন প্রতিনিধিরা। এছাড়া ই-ওয়েস্ট, ড্রাগস এ্যান্ড কসমেটিকস এ্যাক্ট, মেধাস্বত্ব, সরকারী ক্রয় ও শ্রমচর্চার বিষয়েও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্রুত কার্যকর করার তাগিদ ॥ দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে টিকফা করা হলেও কার্যত এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখনও কোন সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়নি। তৈরি পোশাকের ন্যায্যমূল্য, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা এবং জিএসপি পুনর্বহালের মতো বিষয়গুলো অমীমাংসিত রয়েছে। এ কারণে এবারের সংলাপে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, এনার্জি কো-অপারেশন, জলবায়ু তহবিল এবং শুল্ক ও কোটামুক্ত পোশাক রফতানির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে। কমপ্লায়েন্স হওয়ার পরও প্লাস্টিক শিল্পে শুল্কমুক্ত সুবিধা নেই ॥ জিএসপি স্থগিত হওয়ায় সরাসরি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্লাস্টিক শিল্পখাত। কারণ প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যেত। এ প্রসঙ্গে প্লাস্টিক শিল্পখাতের উদ্যোক্তা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, জিএসপি স্থগিত হওয়ায় সরাসরি প্লাস্টিক শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের একান্ত প্রচেষ্টায় দেশে এখন ২৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক শিল্পখাত গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর বিনিয়োগ, রফতানি ও কর্মসংস্থান বাড়ছে এ খাতে। এ কারণে এবারের টিকফায় গুরুত্বের সঙ্গে এটি আলোচনা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, প্লাস্টিক শিল্পের শতভাগ কারখানা কমপ্লায়েন্স। অথচ জিএসপি সুবিধা না থাকায় উদীয়মান এই শিল্পটি এখন অনেক চাপের মুখে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে রফতানি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আশা করছি, টিকফা বৈঠকে সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে।
×