ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চিঠির অপেক্ষা আর নেই ॥ ডিজিটাল যুগে হারিয়ে গেছে হলুদ খাম আর পোস্টকার্ড

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৩ জুলাই ২০১৮

 চিঠির অপেক্ষা  আর নেই  ॥ ডিজিটাল যুগে হারিয়ে গেছে হলুদ খাম আর পোস্টকার্ড

ওয়াজেদ হীরা ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রভাবে হারিয়ে গেছে হলুদ খামের চিঠির যুগ। চিঠির সঙ্গে হারিয়ে গেছে এক সময়ের জনপ্রিয় খোলা ডাক বা ‘পোস্ট কার্ড’। মনের ভাব বিনিময়ের জন্য চিঠি ও পোস্ট কার্ড হরহামেশাই ব্যবহার হলেও এই প্রজন্মের অনেকেই চেনেও না এক সময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগের এই পোস্ট কার্ডকে। ইতোমধ্যেই পুরনো জৌলুস হারাতে বসেছে ডাক বিভাগ। সম্প্রতি ডাক বিভাগ বিভিন্ন সার্ভিসের মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য সার্ভিসের চেয়ে এখনও ডাক বিভাগ কমচার্জ নিচ্ছে এবং একই সঙ্গে আর ডাক বিভাগ আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রভাবে হারিয়ে গেছে হলুদ খামের চিঠির যুগ। টাকা লেনদেনের জনপ্রিয় ‘মানি অর্ডার’ হারিয়ে যেতে যেতে মাঝখানে ইলেক্ট্রনিক মানি অর্ডার প্রবর্তনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এখন আবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চাপে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে। মোবাইল ফোন আর ভিডিও নেটওয়ার্কের এই সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ের যোগাযোগ রক্ষায় চিঠি লেখার চল প্রায় উঠেই গেছে। সেজন্য হলুদ খামের চিঠি আর কেউ লেখে না এখন। এমনকি হারিয়ে গেছে পোস্ট কার্ডও। সম্প্রতি শান্তিনগরের পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট কার্ড চাইলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘এটি দিয়ে কি করবেন?’ অনেকদিন পর আপনিই কেবল চাইলেন! জিপিওর সংশ্লিষ্ট কাউন্টারে পোস্ট কার্ড চাইলে এক কর্মকর্তা বলেন এটির দাম বেড়েছে সম্প্রতি ঠিকই; তবে ক্রেতা নেই বললেই চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের এই জিপিও শাখায় তবুও কিছু ক্রেতা মাঝে মধ্যে এই পোস্ট কার্ড কেনেন। রাজধানীর অনেক পোস্ট অফিসে এটির কথা জানতেই চায় না কেনা তো অনেক দূর। হয়ত আধুনিকতার যুগে এসব ভুলে গেছে সবাই বলেন ঐ কর্মকর্তা। গত কয়েক দিনে সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক পোস্ট অফিস ঘুরে দেখা গেছে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুব একটা পাঠাবেন না কেউ। যারা আসছেন বিভিন্ন দাফতরিক বা অফিসের চিঠিপত্র জমা দিতে। কেউ চাকরি বা নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা জন্য চিঠি দিতে এসেছেন। একটি অফিসিয়াল চিঠি জমা দিতে এসেছেন আঞ্জুমারা সুমি। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অফিসিয়াল ছাড়া চিঠি দেব কাকে। সবার হাতে হাতে ফোন। যেকোন খবর সেকেন্ডের মধ্যেই যেখানে পাচ্ছি সেখানে অপেক্ষা করার সময় কেন নেব। গত ৭/৮ বছরের মধ্যে ব্যক্তিগত কোন চিঠি লেখেন নি বলেও জানান। আর পোস্ট কার্ড নিয়ে বলেন, আমি পোস্ট কার্ড এক সময় দেখেছি। তবে চিঠিই লেখি না আর পোস্ট কার্ড! মালিবাগ পোস্ট অফিসে কথা হয় শাহিনুর আলমের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, কোন চিঠিপত্র পোস্ট করতে নয় সঞ্চয় নিয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। একই অফিসে আরেক তরুণ তাহসান ইমরুল সুজনকে পোস্ট কার্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি আবার পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘এই নামটা আমার কাছে নতুন। চিঠিপত্রের কথা শুনেছি। বাবার কাছে দু’একটা আসত দেখেছি। তবে পোস্ট কার্ড বিষয়টি মাত্রই শুনলাম।’ অবাক হলেও এটিই সত্য। আধুনিকতার এই যুগে অনেকেই জানেন না পোস্ট কার্ডের বিষয়টি। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে এটি এখনও মধুর স্মৃতি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন (৬৭) বলেন, আমাদের যুবক বয়সে এই চিঠিপত্র নিয়ে কতো কি হত। ডাকঘরে লম্বা লাইন দিয়ে চিঠি, পোস্ট কার্ড জমা ও আনতে যেতাম। মনে হয় এই তো সেদিন এইসব নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত কিছুই না করেছি। সময়ের স্রোতে মানুষের জীবন বদলে যাচ্ছে। মানুষ আধুনিক থেকে আরও অত্যাধুনিক জগতে যাচ্ছে। আর বর্তমান যুগে পুরনো সেই চিঠি লেখার অভ্যাস একেবারেই নেই। চিঠি লেখার সেই জায়গাটি এখন দখল করেছে মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তা, ইমেল, টুইটার বা ফেসবুকের চ্যাটিং। প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন ইমু, ভাইভার, হোয়াটস এ্যাপস বা স্কাইপির মতো প্রযুক্তি। ঝামেলাহীন ও দ্রুততার সঙ্গে সংযোগ পাচ্ছে প্রিয় মানুষের। এখনকার যুগের প্রেমিক-প্রেমিকারও বসে থাকে না চিঠির আশায়। হারিয়ে গেছে চিঠি! হারিয়ে গেছে প্রিয়জনকে কাগজে লেখার সেই যুগ। আর তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে ডাকঘরও! কেননা ব্যস্ততা কমেছে ডাক বিভাগের। সাইকেলের বেল বাজিয়ে ডাক পিয়নের ‘চিঠি এসেছে...চিঠি...’ এমন কথাও আর শোনা যায় না। এখন আর সেই আগেকার দিনের মতো পিয়নের পানে চেয়ে থাকতে হয় না প্রিয়জনদের। আধুনিকযোগে চিঠি শূন্য এখন ডাকঘর। প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় এখন আর চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির ছোঁয়া আজ শহর ছেড়ে অজপাড়াগাঁয়েও পৌঁছে গেছে। তাই এসএমএস, মেল আর ফেসবুকে চ্যাটই প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। পরিবারের কেউ দেশের বাইরে কিংবা অন্য কোথাও অবস্থান করলে তার খোঁজ নেয়া হতো চিঠির মাধ্যমে। তাকে বাড়ির খোঁজ দেয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই চিঠি লিখন পদ্ধতি। তখন মোবাইলের মতো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না বলে সবার কাছে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল চিঠি। ডাক বিভাগের প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর রয়েছে। যার মধ্যে বিভাগীয় ডাকঘরের সংখ্যা ১৪২৬ এবং অবিভাগীয় ডাকঘরের সংখ্যা ৮৪৬০টি। যেখানে কর্মরত আছেন ৩৯৯০৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা ১৬৮৮৬ এবং ভাতাপ্রাপ্ত বা অবিভাগীয় কর্মচারীর সংখ্যা ২৩০২১ জন। সংখ্যার বিচারে ভাতা প্রাপ্ত কর্মচারীর সংখ্যা বেশি হলেও এরাই সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় দিন পার করছেন। কেননা এই ভাতাপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। ডাক কর্মকর্তারা বলেছেন, অধিকাংশ শাখা ডাকঘর থেকে বেতনের সমপরিমাণ আয়ও হয় না। এদিকে চিঠিসহ অন্যান্য সেবা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় ডাক বিভাগের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এদিকে, মুঠোফোনের সহজলভ্যতার এই সময়ে যেকোন সময় খুদে বার্তা পাঠিয়ে চিঠির কাজটি সেরে ফেলা যায়। ফলে, হলুদ খামের ব্যক্তিগত চিঠি এখন আর লিখে না মানুষ। খোদ ডাক বিভাগের নতুন প্রজন্মের কর্মীরাও অনেকেই এখন পোস্ট কার্ড চেনেন না। কিনতে চাইলে দেশের অনেক শাখা ডাকঘরের কর্মীরা জানতে চান, পোস্ট কার্ড কী? এদিকে বছর দশেক আগেও ডাক বিভাগ বছরে প্রায় ২২ কোটি চিঠি পরিবহন করত। এর মধ্যে হলুদ খামের ব্যক্তিগত চিঠির পরিমাণ ছিল বেশি। ডাক কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যক্তিগত হলুদ খামের চিঠি কমে গেলেও ইতোমধ্যে বেসরকারী খাতের বিকাশে অফিসিয়াল চিঠির পরিমাণ বেড়েছে। ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, চিঠি হারিয়ে যাচ্ছে বিষয়টি সঠিক নয়। হয় তো ব্যক্তিগত চিঠি কমে গেছে। তবে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করছি। মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে মহাপরিচালক বলেন, আমরা বিশ^ ডাক সংস্থার বিষয়টি দেখেছি। তা ছাড়াও বিভিন্ন সার্ভিসের মূল্য বৃদ্ধি করে আমরা যা নিচ্ছি অন্য কুয়িরারগুলো আরও বেশি নিচ্ছে। ফলে একই জিনিসের মূল্য যখন অন্য জায়গায় অনেক বেশি লাগছে তখন সেটি আমাদের কাছেই ফেরত আসছে। ডাক বিভাগের হারানো ঐতিহ্য নিয়ে ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক প্রবাস চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ডাক সংশ্লিষ্ট মূল্য বাড়ানো যৌক্তিক। বিদেশে প্রতি বছরই আপডেট করা হয়। আর আমাদের দেশে ১৯৭৭ এর পর ২০০৮ এবং ২০১৮ তে বাড়ল। চিঠিপত্র ও পোস্ট কার্ড নিয়ে ডাক বিভাগের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, পোস্ট কার্ড এখনও আছে। আমার সময়ও আমি নববর্ষের শুভেচ্ছা হিসেবে অনেকের নিকট থেকে পেতাম। তবে যুবকদের মধ্যে নেই। তারা ফেসবুকে ঢুকে গেছে। তবে সিনিয়র সিটিজেনরা এখনও এটিকে মূল্যায়ন করেন বলেও জানান। ডাক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডাক বিভাগ বিভিন্ন সেবাকার্যক্রমে অব্যাহত থাকবে। সময়ে সময়ে কিছু হারিয়ে যাবে কিছু নতুন যোগ হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ডাক বিভাগকে বাঁচিয়ে রাখতে সেবামূলক কার্যক্রমের অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত চিঠি কমতে থাকলেও বাণিজ্যিক চিঠিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে গতিশীল করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
×