ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে বাণিজ্য কৌশল

৩ বছরে রফতানি আয় ৬ হাজার কোটি ডলারে নেয়ার চিন্তা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১০ জুলাই ২০১৮

৩ বছরে রফতানি আয় ৬ হাজার কোটি ডলারে নেয়ার চিন্তা

এম শাহজাহান আগামী তিন বছরে রফতানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা দূরীকরণে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ওপর সর্বোচ্চ জোর দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গত সাড়ে নয় বছরে ৪৪ দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। লক্ষ্য অনুযায়ী, ৫০ দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করতে চায় সরকার। পাশাপাশি নতুন বাজার সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএর বিষয়টি এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে সাপটা, সাফটা আপটা ও বিমসটেক প্রভৃতি আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির আওতায় বাণিজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে চীনের সঙ্গে এফটিএ চুক্তির বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশটির সঙ্গে এফটিএ করা হলে বাৎসরিক ২০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে বাংলাদেশ। জানা গেছে, রফতানি আয় বাড়াতে বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি পণ্যের বৈচিত্র্যায়ন, অপ্রচলিত বাজারে রফতানি এবং শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধার সময় বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, রূপকল্প-২১ অনুযায়ী দেশের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন থেকে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করায় উত্তরণ-পরবর্তী বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য কৌশলের পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। তিনি বলেন, রফতানি বাড়াতে বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করা হবে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন ও তুরস্কের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশের রফতানি আয় বাড়বে। সূত্র মতে, যৌথ ইশতেহার ও উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য কাঠামোগত চুক্তির আওতায় আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক পর্যায়ে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংক্রান্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভা হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে সরকার। উপআঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় ইতোমধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি শুরু করা হয়েছে। বিবিআইএন বা বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় ভুটানে জলবিদ্যুত প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। ইতোমধ্যে বিবিআইএন মোটরযান চালনা চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। যোগাযোগখাতে উপআঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং যৌথ এক্সপার্ট গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব গ্রুপ কাজ শুরু করেছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ ॥ ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছে সরকার। চীন জাপান ও সৌদি আরবের সঙ্গে করা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তিগুলোর বর্তমান অবস্থা, বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে শুধু চীনের সঙ্গে প্রায় শতাধিক চুক্তি করা হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরকালে দু’দেশের মধ্যে বেশ কিছু স্বাক্ষরিত চুক্তি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে জাপানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব হবে বাংলাদেশে। বিগ-বি ইনিশিয়েটিভ এর আওতায় বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে এই শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকার জাপানীদের শিল্প ও বাণিজ্য এ্যাসোসিয়েশনের (সো কো কাই) উপদেষ্টা আব্দুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। তাই জাপানের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনা জরুরী হয়ে পড়ছে। মেট্রোরেল, গঙ্গা ব্যারাজ, যমুনা নদীর নিচে টানেল, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো শুধু রেলের জন্য আরেকটি সেতু, মাতারবাড়ি বিদ্যুত প্রকল্প, বহুমুখী ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস ও ঢাকার চারপাশে থাকা চার নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার মতো বৃহৎ অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। তিনি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকার পরও জাপানী বিনিয়োগের বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও মনিটরিং করার উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এসব ঋণের অর্থে এসব প্রকল্পে বাস্তবায়ন হবে। চীনের সঙ্গে এফটিএ হলে শুল্ক জনিত ঝুঁকি বাড়বে ॥ চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের বাৎসরিক ২০ হাজার কোটি টাকার শুল্কজনিত ঝুঁকি তৈরি হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বেজিং সফর করেছেন। ওই সময় এফটিএ সংক্রান্ত যৌথ ওয়াকিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চীনের আগ্রহে এরপরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুল্ক-অশুল্কজনিত যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঝুঁকিজনিত সমস্যা রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, চীনের সঙ্গে এফটিএ হলে বড় অঙ্কের শুল্ক হারাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হিসেবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য পরিমাণ ৮-৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চীনের কাস্টমস বলছে, দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে পণ্য আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে। তাই তাদের দেয়া হিসেবটি অমূলক নয়। চীনের সঙ্গে এফটিএ করার আগে এসব বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তির (এপিটিএ) আওতায় ২০১০ সাল থেকে চীনের বাজারে চার হাজার ৮৮৬ পণ্যেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এফটিএ করার ক্ষেত্রে বেজিংয়ের যুক্তি হলো, এফটিএর মধ্য দিয়ে ঢাকায় চীনের বিনিয়োগ বাড়বে। সেই সঙ্গে ঢাকার রফতানিও হবে বহুমুখী। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ এইচ এম আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, যৌথ সমীক্ষা ও চুক্তি এক জিনিস নয়। এ ধরনের চুক্তি করার আগে বহু পক্ষের মতামত গ্রহণ ও সমীক্ষা প্রয়োজন হয়। আলোচনা চলছে, চলবে। পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় হবে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ সবার আগে। বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য কিংবা শিল্পগ্রস্ত হয় এমন কোন বিষয় আছে কি না সেটা যাচাই করা হচ্ছে।
×