ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে বাঙালী গৃহকর্মীর দুর্বিষহ জীবন

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৯ জুন ২০১৮

সৌদিতে বাঙালী গৃহকর্মীর দুর্বিষহ জীবন

দেশের বাইরে নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কত ধরনের সঙ্কটের মোকাবেলার জর্জরিত হতে হয় তা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের নিয়মিত খবর। নারী শ্রমের আন্তর্জাতিককরণ বর্তমান সময়ের এক বহুল আলোচিত প্রত্যয়। বৈধ পথে বিদেশে এই শ্রম বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই নির্ধারিত বিধি-নিয়মকে তোয়াক্কা না করে যেভাবে বাংলাদেশের নারী শ্রম বিদেশে নিয়োগ নয় বরং পাচার হয় তা যেমন অমানবিক একইভাবে আইনশৃঙ্খলাবহির্ভূতও। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারী শ্রমের যে বিপুল চাহিদা সেখানে অশুভ পাচারচক্র গোড়া থেকেই গলদ শুরু করে দেয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এই দালাল সিন্ডিকেট নারী শ্রমিকদের যে পরিমাণ দুরবস্থার দিকে ঠেলে দেয় তা বর্ণনায়ও আসে না। ফলে বিদেশে গিয়ে তাদের অবস্থান হয় আরও শোচনীয় এবং ভয়াবহ। সম্প্রতি নারী শ্রমিকদের ওপর সৌদি আরবের বিভিন্ন জায়গায় অত্যাচার-নিপীড়নের কথা গণমাধ্যমে সবার নজরে এসেছে। তেমনি সৌদিতে এক সময় কর্মরত নারী মোসাম্মৎ রাহিমা দেশে ফিরে তার প্রবাস জীবনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ব্যক্ত করেছেন। রাহিমা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ ইসমত আরা জুলি ফরিদপুর জেলার চরপাঁচুরিয়া গ্রামের ৩৮ বছর বয়স্ক রাহিমা প্রায়ই দুই বছর আগে সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পায়। সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বৈধ ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়নি। কারণ একই গ্রামের নজরুল যার মূল অফিস কিনা ঢাকায় সেই বিদেশ পাড়ি দেয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে। অশিক্ষিত এই গ্রাম্য নারী বুঝতেও পারে না বিভাবে তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শর্ত অনুযায়ী সত্তর হাজার টাকা দিয়ে সে সৌদি আরবে চাকরি নামের সোনার হরিণের খোঁজে বিদেশে বিভুঁইয়ে পাড়ি জমায়। তার একটি মাসিক বেতনও ধার্য করা হয় ৮০০ সৌদি রিয়েল যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায়ই ১৬ হাজার। অক্ষরজ্ঞানহীন এই নারী পাঁচ সন্তানের জননী। দরিদ্র ভ্যানচালকের স্ত্রী। অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে কষ্টে অর্থ যোগাড় করে সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে চাকরির সন্ধানে সে দেশে যায়। হতদরিদ্র পরিবারটিকে আর্থিক সচ্ছলতা প্রদান করতে তার এই বিদেশ গমন। বাইরে থেকে আয় করে মাথা গোজার একটি ঠিকানা তো তৈরি করা সম্ভব হবে। কিন্তু সৌদির মাটিতে পা দিয়েই বুঝতে পারে যে বুকভরা আশা নিয়ে এখানে আসা তার প্রায়ই সবটা বিফলে যাবে। অশিক্ষিত মেয়েরা বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সবচেয়ে প্রথম যে সঙ্কটের মোকাবেলা করে তা হলো ভাষাগত সমস্যা। তার পরেও আছে সে দেশের কর্তা-কর্ত্রীদের দখলদারিত্বের মনোবৃত্তি। সকাল থেকে রাত অবধি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর ঘুমের সময় বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সৌদির খাবার আর বাংলাদেশের খাদ্য তালিকার আকাশ-পাতাল তফাত। সেটাও নীরবে নিঃশব্দে হজম করতে হয়েছে। খাবারের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর বস্তু মিশিয়ে দেয়া হতো যাতে সে খেতেই না পারে। এ ছাড়াও ছিল উপরি পাওনা। কর্তা মহাশয় কিংবা তার সুযোগ্য পুত্রের অকথ্য প্রস্তাব। এমন অত্যাচার আর নিপীড়নের মধ্যেও রাহিমা তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কোন কুণ্ঠিত হয়নি। অবশ্য সে সুযোগও তার ছিল না। প্রথম এক বছরে মাত্র চার মাসের বেতন সে দেশে পাঠাতে পেরেছে। বাকি আট মাসের টাকা তাকে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয় সে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পরবর্তীতে সে তার চাকরির জায়গা বদল করে। এভাবে দুই বছরে প্রায়ই ৩ জন সৌদি গৃহকর্তার অধীনে সে তার নির্ধারিত পেশা চালিয়ে যায়। তবে প্রথম অভিজ্ঞতার চাইতে ভাল কোন অবস্থায় সে কখনই ছিল না। কারণ তিনটি বাসার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এক ও অভিন্ন। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম, নামেমাত্র খাওয়া আর রাতে পশুবৃত্তির শিকার হওয়া। এমন অমানবিক নৃশংসতা সভ্যতার করুণ বিপর্যয়। গৃহকর্মীদের অধিকার কিংবা স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছুই থাকে না। রাহিমারও ছিল না। কারও সামনে আসা কিংবা কথা বলার কোন সুযোগই দেয়া হতো না। একা, নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে দিনভর খাটাখাটনিতে জীবনটা একেবারে অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকে যেত। দেশে স্বামী সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারেও কঠিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। স্বামী মাঝে মাঝে ফোন করলেও আড়ালে আবডালে কথা বলার চেষ্টা চলত। চরম দুর্বিপাকে পড়া এই নারীর এক সময় মনে হয়েছিল জীবনটা বুঝি শেষই হয়ে গেল। স্বামী সন্তানের মুখদর্শন বোধহয় আর কপালে নেই। অনাহার, অর্ধাহার আর অত্যাচারের বলি হতে হতে এক সময় লাশ হয়ে হয়ত প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাবে। দুটো বছর ছিল তার কাছে যুগ-যুগান্তর। এক সময় সে কিছুটা আরবী শব্দ আয়ত্ত করে। আর সেভাবেই আকার ইঙ্গিতে গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রীর কাছে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হতো। মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি জুড়ে দিত নিজের মায়ের অসুস্থতার কথা বলে। এক সময় গৃহমণিব সহৃদয় বিবেচনায় তাকে দেশে যাওয়ার অনুমতি দিলেও পুনরায় ফিরে আসার প্রতিজ্ঞাও করিয়ে নেয়। কিন্তু দেশে ফেরার জন্য বিমানে ওঠার আগ পর্যন্ত তার জন্য কোন নিয়মমাফিক বিধান প্রয়োগ করা হয়নি। কোন মতে পাসপোর্ট আর বোডিং পাস হাতে ধরিয়ে এক কাপড়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় এক প্রকার ঠেলেই তাকে বিমানে তুলে দেয়া হয়। নিঃসম্বল আর অসহায় অবস্থায় যখন সে ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখে তখন তার কান্না ছাড়া আর কোন উপায় হাতে ছিল না। কারণ বাড়ি অবধি পৌঁছানোর জন্য যে যৎসামান্য টাকার প্রয়োজন সেটাও তার ছিল না। দেশের মাটিতে কিছু বিবেক আর হৃদয়বান ব্যক্তির সহায়তায় তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়। আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে এবং বহুবিধ সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার চরম উৎকর্ষে ও স্বাধীন দেশের নারীদের জীবনে এমন শ্বাপদ সঙ্কুল অরণ্যের কথা ভাবাও যায় না। সভ্যতা সূর্য যখন মধ্যাহ্নে তখন অসভ্যতার চরম নিদর্শন কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব। সুতরাং আমাদের মেয়েদের সাবধান হতে হবে যাতে কোন পাচারকারী চক্রের আবর্তে পড়ে অসহায় এবং দুর্বিষহ জীবনকে বয়ে বেড়াতে না হয়। স্বচ্ছ এবং বৈধ পথে বিদেশে শ্রম-বিনিয়োগ করা অন্যায় কিছু নয়।
×