দেশের কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের বেশ কিছু অসাধারণ সাফল্য আছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটেও কিছু ভাল উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদানের কথা স্বীকার করা হয়েছে, কৃষির জন্য নেওয়া নানা উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছে এতে। কৃষি জমি নিবন্ধনের ওপর ভ্যাট তুলে দেওয়া হয়েছে, গবাদি পশুর খাবারের উপকরণ মিরেট বীজ আমদানিতে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২২টি নতুন জাতের শস্য উদ্ভাবন এবং ২১টি নতুন প্রযুুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব কৃষিতে যে পড়বে তা নিশ্চিত। এই উদ্যোগগুলোর জন্য সরকার এবং অর্থমন্ত্রী প্রশংসা পেতে পারেন। কিন্তু কৃষি ও কৃষকের বর্তমান সঙ্কট এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? প্রশ্নটা সেখানেই।
২০৫০ সালের মধ্যে দেশে খাদ্য শস্যের চাহিদা ৩০% বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছর ধরে শতকরা ১-এরও নিচে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ৭.৫৭% থাকলেও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি ০.৫৯%। বর্তমান অর্থবছরে এই হার ০.৯৮%। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে না পারলে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে দেশ। খাদ্যশস্য উৎপাদনে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে জরুরি কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রস্তাবিত বাজেটে খুব কার্যকর কোন দিক নির্দেশনা নেই।
চাল আমদানির ওপর শুল্ক ২% থেকে বাড়িয়ে ২৮% করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এতে করে দেশের কৃষকরা চালের বা ধানের ভাল দাম পাবেন। প্রকৃত অর্থে এটা করা উচিত ছিল আরও অনেক আগে, যখন কৃষকের কাছে ধান বা চাল ছিল। এখন প্রায় কোন কৃষকের কাছেই ধান বা চাল নেই। তারা অনেক আগেই সেগুলো বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে এর সুফল পেতে পারে মধ্যস্বত্বভোগীরা। চাল আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে ইতোমধ্যেই তারা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া এর আগেই বিপুল পরিমাণ চাল বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। ১০ লাখ টন চালের ঘাটতির বিপরীতে আমদানি হয়ে গেছে ৮২ লাখ টন! এই চাল এখন বাজারে।
বাজেট বক্তৃতায় দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষির অবদানের কথা রয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার সময় কৃষিকে আসলে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রকৃত বরাদ্দ বরং কমানো হয়েছে। এই অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ১৬% (সংশোধিত বাজেট ধরলে তা প্রায় ২৩%)। অথচ কৃষির জন্য বরাদ্দ কমেছে ০.৪১%! অবশ্য সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ০.২১% বেড়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ২.৯৯%, বর্তমান অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩.৪০%, কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২.৭৮%। সুতরাং এই ২.৯৯% -ও যে শেষ পর্যন্ত কমে যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য। বলা হয়, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাত সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এই খাত মানে দুটি মন্ত্রণালয় এবং আলাদা আলাদা অনেক খাতের সমন্বয়ে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ২১.৮% তিনি বরাদ্দ করেছেন সার্বিক কৃষি খাতে। এটা হলে খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু এই সার্বিক কৃষি খাত মানে কিন্তু কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানি সম্পদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য! প্রকৃত অর্র্থে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বার্ষিক কর্মসূচীর মাত্র ১.১% বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ১.২% রাখা হলেও, সংশোধিত বাজেটে তা করা হয় ১.০%।
তাছাড়া বাজেট বরাদ্দই বড় কথা নয়, সেই বাজেটের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করাই আসল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েচিল ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে সেটা হয়েছে ১০ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এমনিতেই অপ্রতুল বরাদ্দ। তাও যা বরাদ্দ হয় তার ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কৃষি ও কৃষকের সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় কৃষির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। সম্ভব না হলে যে ১৩ হাজার ৯১০ কোটি টাকার বরাদ্দ আছে তার সদ্ব্যবহারটা অন্তত নিশ্চিত করাটা জরুরী।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের মতো ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও কৃষিতে ভর্তুকি ৯০০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৫.৬% ধরলে এই অর্থের পরিমাণ এমনিতেই বর্তমান বরাদ্দের চেয়ে কমে যায়, যদিও কৃষকদের দাবি ছিল ভর্তুকি আরও বাড়ানো। তবে ভর্তুকি শুধু ঘোষণায রাখলেই হবে না, নিশ্চিত করতে হবে এর কার্যকর ব্যবহারও। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০০০ কোটি রাখা হলেও, সংশোধিত বাজেটে তা করা হয় ৬০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩০০০ কোটি টাকা ব্যবহার করা যায়নি। এছাড়াও, এই যে ৬০০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলো, তাও যেন প্রকৃত কৃষকের কাছে যায় এবং এবং এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হয়, সেটাও দেখতে হবে।
বীজের ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, বিভিন্ন কোম্পানির ওপর নির্ভরতা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি করে। দেশে বার্ষিক বীজের চাহিদা ১১ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা হয় ৬ লাখ ১০ হাজার টন, ৫৩%। বাকি ৪৭% এর উৎস অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহকৃত বীজের দ্বারা প্রায়ই কৃষক প্রতারিত হয় আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বীজের মানের ব্যাপারেও কোনও স্পষ্ট গবেষণা নেই। সরকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও বিতরণে দক্ষ ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোন প্রতিফলন নেই।
সম্প্রতি হাওড় এলাকার কৃষক অকালবন্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আশা করা হয়েছিল বাজেটে হাওড় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য জরুরী সহায়তার জন্য বরাদ্দ থাকবে। হাওড় ও উপকূলীয় এলাকার জন্য কিছু উদ্যোগের কথা বাজেট বক্তৃতায় থাকলেও, এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও বরাদ্দ নেই।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এই বছর প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা হলেও, কৃষক ধানের দাম পাচ্ছেন মণ প্রতি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকার মতো। ধান ছাড়াও অনেক সবজির ন্যায্য দাম কৃষক পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন ধরেই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য এবটি কমিশন গঠনের দাবি ছিল, সেই দাবি উপেক্ষিত হলো এবারও।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামী বিশ্ব ব্যবস্থায় খাদ্য হবে রাজনীতি-অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি। খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের কোন বিকল্প আমাদের কাছে নেই। আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০০৮ সালে অনেক ডলার হতে নিয়েও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, প্রতি বছর ১% হারে কৃষি জমি হারানো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়নের ফলে অকৃষি খাতে কৃষি জমি চলে যাওয়া, কৃষিতে আন্তর্জাতিক মুনাফালোভীর দৃষ্টি ইত্যাদি নানা চ্যালেঞ্জ আসছে আগামীতে খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনের সংগ্রামে। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এসব বিষয় আমাদের সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
লেখক : উন্নয়নকর্মী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক