ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহাজ নির্মাণ শিল্প এখন তালতলীতে

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৮ এপ্রিল ২০১৮

জাহাজ নির্মাণ শিল্প এখন তালতলীতে

নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ ট্যাংরাগিরি বনাঞ্চলের সন্নিকটে পায়রা নদী সংলগ্ন তালতলীর তেঁতুলবাড়িয়ায় নৌবাহিনী ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খাঁন ওই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনে পর্যটন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির আকাক্সক্ষায় এলাকার মানুষ আনন্দিত। অপরদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কায় তারা বিচলিত । ১৯৬০ সালে গ্রিক জাহাজ এমডি আলপাইন নামক একটি জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতে বিকল হয়ে পরে। ওই জাহাজটি স্থানীয় লোকজন ও চট্টগ্রামের স্টিল মিলের শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে রশি দিয়ে টেনে সমুদ্র তীরে নিয়ে আসে। ওই জাহাজের যন্ত্রাংশ পুনরায় ব্যবহারের জন্য শ্রমিকেরা জাহাজটি ভেঙ্গে ফেলে। ওই সময় থেকে শুরু হয় বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের পদার্পণ। এরপর থেকে দিন দিন প্রসারতা বৃদ্ধি পায় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ ট্যারাগিরি বনাঞ্চলের সন্নিকটে নলবুনিয়া বনাঞ্চলের ৫০০ মিটার দূরে পায়রা নদী সংলগ্ন তালতলীর তেঁতুলবাড়িয়ায় সম্ভাবনাময় পরিবেশ বান্ধব জাহাজ শিল্প গড়ে তোলার জন্য নৌবাহিনী ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুটি পৃথক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বরগুনা জেলা প্রশাসক অফিস সূত্রে জানা গেছে, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড এর সম্প্রসারণের জন্য ১৬২ একর এবং শিপ বিল্ডিং ও শিপ রিসাইক্লিং এর জন্য ১০৫ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত তেঁতুলবাড়ীয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। পৃথক দুটি ভারী জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প কারখানা বাস্তবায়নের জন্য ৮শ’ কোটি টাকা অনুমোদন এবং ইঝঊঈ এর মাধ্যমে ১৮.৯০ কোটি টাকার ঋবধংরনরষরঃু ংঃঁফু শেষ হয়েছে। বরগুনা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নুরুজ্জামান অনাপত্তিসহ জমির অবস্থা, ভৌগলিক অবস্থা, বাস্তুসংস্থান (বপড়ষড়মু) ও জীববৈচিত্র্য (নরড়ফরাবৎংরঃু) নিয়ে ওই এলাকা পরিদর্শন শেষে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছে। জাহাজ ভাঙ্গা একটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পুরানো জাহাজের লোহার ওপরে অংনবংঃড়ং ও চড়ষুপযষড়ৎরহধঃবফ ইরঢ়যবহুষং রাসায়নিক পদার্থের আস্তরণ দেয়া থাকে। ওই পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গা কিংবা কাটার সময় অংনবংঃড়ং মিশ্রিত বিষাক্ত ধূলা, মারাত্মক বিষাক্ত পারমাণবিক বর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক টক্সিন ও প্রাণঘাতী যৌগ নির্গত হয়। ওই বিষাক্ত উপাদানগুলো সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকার বাস্তুসংস্থানের চরম ক্ষতিকর। জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প চালু হলে এলাকার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও এলাকা উন্নত হবে এমনটাই আশা করছে এলাকাবাসী। অপর দিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় সঙ্কিত তারা। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে সে দিকে সংশ্লিষ্ট দফতরে সজাগ দৃষ্টি রাখার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ৮০ বছর বয়সী জলনুল আবেদীন বলেন ‘মোগো বইন্যা এলাকায় জাহাজ ভাঙ্গবে, মোগো পোলাপান নাতি নাতনি চারহি হরবে, এ্যাতো খুশিরই’। এইয়্যার উচিলায় যদি মোগো গাঙ্গডা ভাঙ্গা শ্যাষ অয়’। ওই এলাকার আলী আকবর বলেন, ‘মোর পোলা এই দ্যাশে ২০ বচ্চর অইছে মাছ ধইর‌্যা খায়, কারখানা অইলে মোর নাতিগো হেইডা আর হরা লাগবে না’। আইয়ূব আলী হাওলাদার বলেন, শিল্প কলকারখানা হলে এলাকা উন্নত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ ট্যাংরাগিরি বনাঞ্চলের পাশে জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে ধ্বংসের আশঙ্কায় রয়েছে ট্যাংরাগিরি বনাঞ্চল। এ বনাঞ্চল রক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শিল্প কারখানা গড়ার দাবি জানাই। পটুয়াখালী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ডিএফও মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, জাহাজ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়লে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। রবিশাল পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মোঃ আরেফিন বাদল বলেন, জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পরবে। তিনি আরও বলেন, জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত কোন আবেদন পরিবেশ অধিদফতরে দেয়নি। আবেদন পেলে পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব না পরে তা নিশ্চিত করেই ছাড়পত্র দেয়া হবে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের প্রভাষক পাপড়ি হাজড়া বলেন, জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন হলে ওই এলাকায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পরবে। গ্রীন হাউস গ্যাস ও সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হবে। জাহাজ নির্মাণের বর্জ্য নদী ও আশপাশ এলাকায় অপসারণ করা হলে ওই এলাকায় দূষণ বাড়বে। জাহাজ ভাঙ্গার সময় আল্ট্রাসোনিক সাউন্ট ব্যবহারের ফলে শব্দ দূষণ অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। জ্বালানী তেল ব্যবহারের ফলে অয়েল পলিওশন হবে। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ও তৈল দূষণ হলে জীব বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন হবে। অধিক মাত্রায় শব্দ দূষণে ট্যাংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বংশবৃদ্ধিতে সমস্যায় পড়বে। ফলে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। তিনি আরও বলেন, নদীতে জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণের বর্জ্য অপসারণ হলে মৎস্যকূলের বংশ বিস্তারের মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। পরিবেশ দূষণের ফলে শ্রমিক ও এলাকার মানুষের শরীরে নানাবিধ রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাধ শম্ভু বলেন, তালতলীর তেঁতুলবাড়ীয়া এলাকায় জাহাজ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নৌ বাণিজ্যের সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৫০/৬০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ প্রস্তুত ও জাহাজ প্রক্রিয়াকরণ তৈরির জন্য এটা বিশাল ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, তেঁতুলবাড়ীয়ায় এ শিল্পের ভবিষ্যত সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। ওই এলাকায় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকা শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান পরিদর্শন করেছেন। আশা করি অল্প দিনের মধ্যে প্রকল্পের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে কাজ শুরু হবে।
×