ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাখাইনে রোহিঙ্গা বসতিতে মিয়ানমারের নয়া কার্যক্রম

গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলতে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেনা তত্ত্বাবধানে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলতে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেনা তত্ত্বাবধানে

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা ও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলতে সে দেশের সেনা তত্ত্বাবধানে পাহাড় কেটে মাটিচাপা দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যদিও এ ধরনের তথ্য বিশ্বজুড়ে প্রচার পাওয়ার পর মিয়ানমার সরকার তা অস্বীকার করেছে। বলেছে, প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য আশ্রয়ক্যাম্প গড়ে তুলতে এ কাজ চলছে। ওপারের সূত্রগুলো বলেছে, মঙ্গলবারও দেখা গেছে অসংখ্য বুলডোজার লাগিয়ে সেনা তত্ত্বাবধানে পাহাড় কাটার কার্যক্রম। যেখান থেকে মাটি নিয়ে রোহিঙ্গা বসতিগুলোর চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। ওপারের সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া বর্বরতা এবং তাদের বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি জোরালো হচ্ছে, তখন মিয়ানমার সরকার রাখাইনে বেশকিছু আশ্রয় শিবির গড়ে তুলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা যেসব স্থানে বসবাস করত সে সব পল্লী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়ার পর এখন তা সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে তৎপর রয়েছে মিয়ানমার সরকার। ফলে সকাল-সন্ধ্যা চলছে অসংখ্য বুলডোজার লাগিয়ে পাহাড় কেটে মাটি নেয়ার কর্মযজ্ঞ। মিয়ানমারে নিয়ম রয়েছে সে দেশে বসবাসরতদের কেউ নিজের ভিটেমাটি ফেলে অন্যদেশে চলে গেলে তাদের জমিজমা সরকারের অধীনে চলে যায়। তাদের জমিজমা সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে। রাখাইন রাজ্যে দফায় দফায় বর্বর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে গোটা রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। যেসব স্থান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে সে সব স্থানের বসতিগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করার পর তা এখন মাটিচাপা দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিয়েছে সে দেশের সরকার। এ প্রক্রিয়ায় গত একসপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অর্ধশতাধিক গ্রামের সব ধরনের স্থাপনা, ফসলি জমিতে পাহাড় থেকে মাটি এনে ভরাট করা হয়েছে। আগামীতে রোহিঙ্গারা যদি কখনও নিজভূমে ফিরে যায় তাহলে তাদের নিজের পক্ষেও পূর্বের বসতভিটা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় মিয়ানমার সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রত্যাবাসন শুরু হলে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রাখাইন মুসলিমদের বাড়িঘরের যত কাছে সম্ভব পুনর্বাসন করা যায় সে লক্ষ্যেই পাহাড় কাটা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ নবেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ মিয়ানমার একটি সমঝোতা স্মারক হয়। ওই স্মারক চুক্তির অধীনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সুষ্ঠু, সম্মানজনক ও নিরাপদ করতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে। এদিকে, দিন যতই গড়াচ্ছে ততই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত সেনা অভিযানের চিত্র সারাবিশ্বে বেশি ফলাও হচ্ছে। উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শনে একের পর এক আসছেন বিভিন্ন দেশের সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান, দূত, মন্ত্রী, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা এবং সর্বশেষ সফর করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিন দেশের তিন নারী। এদের সফরের পর প্রদত্ত বক্তব্য বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার পাচ্ছে। মিয়ানমারের সেনা প্রধানসহ জেনারেলদের ওপর অবরোধ আরোপের দাবিও উঠেছে। এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে বিচারের আওতায় আনার বক্তব্যও এসেছে। সে দেশের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে ইইউ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। সর্বশেষ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস জেনেভায় হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে প্রদত্ত এক ভাষণে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ নিয়ে অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নতুন অনুপ্রবেশ থেমে নেই ॥ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নতুন নতুন অনুপ্রবেশ থেমে নেই। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন চুক্তির পর মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করেনি। ফলে প্রতিদিন নৌকাযোগে নাফ নদী পেরিয়ে ও সাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা টেকনাফ উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে।
×