ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুরো নির্বাচনের আমেজ, ভোটার ১ কোটি ৪ লাখ- তবে সকলেই শিশু

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮

পুরো নির্বাচনের আমেজ, ভোটার ১ কোটি ৪ লাখ- তবে সকলেই শিশু

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলেই কি আর বসে থাকবে শিশুরা? সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতসহ নানা আতঙ্কে যুগের পর যুগ উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকলেও বসে থাকেনি দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিশু-কিশোররা। কোন রকমের বিরোধ নয় বরং উৎসবের আমেজে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে মেতেই তারা ছাত্রসংসদের আদলে করে দেখাল স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন। প্রায় এক কোটি ৪ লাখ শিশু-কিশোর নির্বাচন করল তাদের পছন্দের ২২ হাজার ৬৪৪ জন প্রধানমন্ত্রী আর এক লাখ ৮১ হাজার ১৫২ জন মন্ত্রী! শনিবার প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনের পর সোমবার ছিল নির্বাচনের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। প্রথম দিনের মতো এদিনও ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচনী উৎসবের আমেজ। সাধারণ মাধ্যমিক স্কুল ও দাখিল মাদ্রাসায় চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে এ নির্বাচন। সোমবার সকালে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে রাজধানীর লালবাগের আবদুর রাজ্জাক দাখিল মাদ্রাসার শিশুদের উৎসবে শামিল হয়েছিলেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সকালে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায় পুরো এলাকা জুড়ে হাতে লেখা পোস্টার, লিফলেট। প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পারা ষষ্ঠ শ্রেণীর শিশুদের আনন্দ ছিল একটু বেশিই। এ রকম অভিজ্ঞতা যে ওদের জীবনে আর আসেনি। তাই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে সবাই। ভোট দেয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকে। যাদের ভোট দেয়া শেষ, তারা মেতে ওঠে আনন্দে। কেউ কেউ নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে স্লোগানে মাতিয়ে তুলছে পুরো স্কুল ক্যাম্পাস। নির্বাচন দেখতে আসা শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র পরিচালক মোঃ ফসিউল্লাহ সন্তোষ প্রকাশ করে বলছিলেন, এইযে ছোট ছোট শিশু-কিশোররা সারাদেশে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উৎসবের মধ্য দিয়ে নির্বাচন করে ফেলল। কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। নির্বাচন পরিচালনা ও তদারককারী এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আরও বলছিলেন, সারাদেশ থেকেই ভাল সাড়া মিলেছে। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিষয়টিকে নিয়েছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে। ভোট চলাকালে সকাল ১০টার দিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রার্থী সুমনের পক্ষে একদল ছাত্রকে ব্যান্ডের তালে তালে স্লোগান দিতে দেখা যায়। মিছিলকারীদের মধ্য থেকে ছাত্ররা জানায়, জীবনে প্রথম মিছিল করায় তাদের খুব আনন্দ হচ্ছে। তারা আরও বলল, যে প্রার্থী হয়েছে, সে তাদের বন্ধু। নির্বাচনে প্রার্থীরাও ছিল মহাব্যস্ত। এক প্রশ্নের জবাবে প্রার্থী সুমন বলছিল, একজন নেতা হতে হলে লেখাপড়ায় ভাল, সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার যোগ্যতা, প্রকাশ করার যোগ্যতা লাগে। তার ওই সব যোগ্যতা আছে কি না- জানতে চাইলে হৃদয় বলে, ‘আমি তো দাঁড়াই নাই। সবাই মিলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। না থাকলে তো দিত না।’ রাজধানীর তেজগাঁও মডেল স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা যায় ক্যাম্পাসে শিশুদের মিছিল। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বুথের মুখে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন। শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বেও তৎপর শিক্ষার্থীরাই। নবম শ্রেণীর বালিকা শাখার ভোটকক্ষে গিয়ে দেখা গেল প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছে একই শ্রেণীর শিক্ষার্থী নাজমা। পোলিং অফিসার হিসেবেও আছে দুজন। তারা ভোটারদের হাতে নিরাপত্তা চিহ্ন হিসেবে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচনে এই ক্লাসের দুজন প্রার্থী। তাই তাদের পক্ষে রয়েছে দুজন এজেন্ট। তারাও পাশাপাশি বসা। এক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সুলতানা বলছিল, নিজেদের ভোট তাই সুশৃঙ্খলভাবে সবাই ভোট দিচ্ছে। কোন সমস্যা হচ্ছে না। এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদও জানাল শিশুরা। বিদ্যালয়ে যে ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছিল তা টের পাওয়া যাচ্ছিল বাইরে থেকেই। শিক্ষার্থীদের কোলাহল আর স্লোগান শোনা যায় বেশ দূর থেকেও। প্রবেশপথেই দেখা যায়, দুই পাশে রশিতে ঝোলানো হাতে লেখা নানা রঙের পোস্টার। তাতে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে নানা আকুতি। ‘বন্ধু তোমার একটি ভোটে, যোগ্য প্রার্থী যাবে জিতে’, ‘মরিয়মের দুই নয়ন/আদর্শ স্কুলের উন্নয়ন’, ‘ভোটে এসেছি প্রথমবার/পাশে চাই আমি সবার’, ‘উড়ছে পাখি দিচ্ছে ডাক/ রাশেদ চৌধুরী জিতে যাক’ ইত্যাদি স্লোগান সংবলিত শত শত পোস্টারে রঙিন বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মূলত এমন একটি উৎসবের মধ্য দিয়েই সারাদেশেই দুইদিনব্যপী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে মন্ত্রিসভা। ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ, উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করা আর শিশুদের মাঝে গণতন্ত্র চর্চার লক্ষ্যকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয়েছে স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন। মোট ২২ হাজার ৬৪৪টি মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেসব প্রতিষ্ঠানে শনিবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি সোমবার সেখানে শিক্ষার্থীরাই নির্বাচন করে তাদের নেতানেত্রী। কেউ হয় প্রধানমন্ত্রী, কেউ হয় শিক্ষামন্ত্রী, কেউ পরিবেশ মন্ত্রী, কেউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার কেউ হয়েছে ক্রীড়ামন্ত্রী। এখন থেকে এক বছর কেউ দেখবে শিক্ষা, কেউ দেখবে স্কুলের পরিবেশ, কেউ দেখবে আইনশৃঙ্খলা আবার কেউ দেখবে খেলাধুলার সকল বিষয়। জাতীয় শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান বুরো (ব্যানবেইস) জানিয়েছে, ভবিষ্যতে এই নির্বাচন দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য আছে সরকারের।
×