ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ ঘোড়ার গাড়ি

বিলুপ্তপ্রায় টমটম আজ শখের বাহন, প্রজন্মের কাছে ইতিহাস...

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

বিলুপ্তপ্রায় টমটম আজ শখের বাহন, প্রজন্মের কাছে ইতিহাস...

হারেজুজ্জামান হারেজ ॥ বেশি দিনের কথা নয়, ৮০’র দশকেও মফস্বল শহর ও অগ্রসরমান গ্রামীণ জনপদে মানুষের প্রধান বাহন ছিল ঘোড়া-চালিত টমটম। এখন যেমন শহরের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এলাকায় রিক্সা, ভ্যান, টেম্পো, অটোরিক্সা ও ইজিবাইক নামক বিভিন্ন জনপ্রিয় যানবাহনের স্ট্যান্ড রয়েছে ঠিক তেমনি ওই স্থানগুলোতে ছিল টমটম স্ট্যান্ড। সেই টমটমে চেপেই মানুষ যাতায়াত করত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল হতে শুরু করে যানবাহন। দ্রুত গতির যান্ত্রিক যানবাহনের দাপটে কমতে কমতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে টমটম। বর্তমানে সেই টমটম হয়ে গেছে শখের বাহন। নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ। এক সময় রাজকীয় এবং জমিদারী বাহন হিসাবেও টমটম ছিল মর্যাদার প্রতীক। খ্যাতি ছিল জগতজোড়া। রাজপথ বা মেঠোপথে চলার সময় ওভারটেক করার সময় ও পথচারীদের সাবধান করতে যান্ত্রিক কোন ভেঁপু বা হর্ন না থাকলেও টমটমের চালক বিশেষ ধরনের হর্ন ব্যবহার করত। সেটি হচ্ছে ঘোড়া তাড়ানোর চাবুকের ছড়ির পেছনের অংশ চলন্ত টমটমের চাকায় চেপে ধরত। ফলে বেশ জোরে খটখট শব্দ হতো। সেই শব্দই ছিল ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমের হর্ন। আর খটখট শব্দ শুনে সামনে থাকা বা বিপরীত দিক থেকে আসা টমটম সাইড নিত এবং দিত। সেই সঙ্গে উভয় দিকের পথচারীরাও মূল রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে যেত। এ প্রজন্মের মানুষের কাছে কেচ্ছা-কাহিনী মনে হলেও এটি বাস্তব বিষয়। সনাতন ধর্মের একটি সম্প্রদায় টমটম ব্যবসায়ী এবং চালকের কাজ করত। স্থানীয়ভাবে তারা ‘কোচোয়ান’ নামে ব্যাপক পরিচিত। তাদের বসবাস এলাকাকে কোচোয়ানপাড়া ও কোচোয়ানপট্টি হিসেবে অবিহিত করা হত। সান্তাহার শহরে এখনও রয়েছে কোচয়ানপট্টি- যেখানে ওই সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তবে তারা পেশা বদলিয়েছে অনেক আগেই। যান্ত্রিক যুগে সেই ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে কে না চায় ? ধনী-গরিব ছোট-বড় সবারই প্রিয় ও শখের গাড়ি হিসেবে হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে ঘোড়ায়চালিত টমটম। এখন বৈশাখ বরণ ও নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে ঘোড়ার গাড়ি বিশেষ প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছোট আখিড়া গ্রামের রেজাউল ইসলাম জীবিকার তাগিদে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া তথা হারানো ঐতিহ্যকে ফেরাতে বেশ কিছুদিন হলো চালু করেছে এই বাহন। বগুড়ার আদমদীঘিতে বিলুপ্ত এই বাহন পুনরায় চালু হওয়ায় অনেকেই বিশেষ করে ৮০ দশকের পরের প্রজন্মের মানুষ ঘোড়ার গাড়ি টমটমকে এক নজর দেখা ও চেপে বসার জন্য ভিড় জমাচ্ছে। ইতিহাস জানা প্রবীণদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ইংরেজ শাসন আমলে ১৮ শতকে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। মিস্টার সিরকো নামক এক আর্মেনীয় প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা তখন ‘টানা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে অনেক যাত্রী শখ করে আদমদীঘি উপজেলা সদর থেকে উপজেলার জংশন ও পৌর শহর সান্তাহার, ছাতিয়ানগ্রাম, মুরইলসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য এই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ছে। তাছাড়া আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও এই ঘোড়ার গাড়িকে দেখা হয় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। একটি ঘোড়ার গাড়িতে ৮ থেকে ১০ জন যাত্রী বহন করে থাকে, যা ঘোড়ার ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। আগের দিনে অনেকে বিয়ের অনুষ্ঠানেও শখ করে পালকির পরিবর্তে এই গাড়িতে চড়ে কনে যেত বরের বাড়ি।
×