ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

নিরাপদ প্রজনন ও ইলিশ উৎপাদনে সফলতা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৮ অক্টোবর ২০১৭

নিরাপদ প্রজনন ও ইলিশ উৎপাদনে সফলতা

৩০ সেপ্টেম্বর, শনিবার মধ্যরাত থেকে শেষ হলো বর্ষাকালীন ইলিশ মৌসুম। মা-ইলিশ রক্ষার মাধ্যমে প্রজনন নির্বিঘœ করার উদ্দেশ্যে এদিন থেকে শুরু হয় ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরা, মজুদ, পরিবহন ও বেচাকেনায় নিষেধাজ্ঞা। ২২ অক্টোবর মধ্যরাতে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও ১ নবেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে জাটকা রক্ষা কর্মসূচী। যা অব্যাহত থাকবে আগামী বছরের ৩০ মে পর্যন্ত। গত কয়েক বছরের মতো সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও ইলিশ উৎপাদন রেকর্ড করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন এবং এ সবের সফল বাস্তবায়নেই এটি সম্ভব হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট মহলগুলো থেকে বলা হয়েছে। ইলিশ নিয়ে বাঙালীর উচ্ছ্বাস বরাবরই আবেগপ্রবণ। ইলিশ শুধু জাতীয় মাছই নয়। এর রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য। প্রাকৃতিক এ সম্পদ বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতির ইতিহাসকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এক সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ১৬০টি নদীতে ইলিশের দেখা মিলত। পদ্মার ইলিশ পৌঁছে গিয়েছিল খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু অতি আহরণ, পরিবেশ দূষণ ও আবাসস্থলের ক্ষতির মতো প্রধানত কয়েকটি কারণে গত শতকের আশির দশকে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। পরবর্তীতে দুই-তিন দশকে বিশেষ করে গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ এবং সে সবের সফল বাস্তবায়নে ফিরে আসে ইলিশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য। ইলিশের উৎপাদন গত কয়েক বছরে রেকর্ড সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন লাখ টন। পরবর্তী বছরে তা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২ শ’ টনে পৌঁছে। ২০১৬ সালে উৎপাদন সাড়ে চার লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। আর চলতি মৌসুমে উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে পৌঁছানোর আশাবাদ সংশ্লিষ্ট সব মহলের। এমনকি কোন কোন মহল থেকে উৎপাদন আরও বেশি হওয়ার আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ইলিশের ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে সরকারের যে কয়েকটি উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, তার অন্যতম হচ্ছে মা-ইলিশ সংরক্ষণ কর্মসূচী। ২০০৮ সাল থেকে এ কর্মসূচী চালু হয়। শুরুতে এর মেয়াদ ছিল ১১ দিন। যা পরবর্তীতে ২২ দিন করা হয়। বাংলাদেশের জলজ ইকোসিস্টেমে সব সময় কমপক্ষে শতকরা ত্রিশ ভাগ ইলিশ ডিম বহন করে। প্রজননের ভর মৌসুমে ডিম বহনকারী ইলিশের সংখ্যা শতকরা ৬০-৭০ ভাগ বেড়ে যায়। চন্দ্রমাস পরিবর্তন যোগ্য হলেও মৎস্য বিজ্ঞানীরা প্রধানত বাংলা আশ্বিন-কার্তিক বা ইংরেজী অক্টোবর মাসের পূর্ণিমা ঘিরে ইলিশের প্রধান বা ভর প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ সময়ের প্রজননকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করার উদ্দেশ্যে পূর্ণিমার আগের ৪ দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরের ১৭ দিন অর্থাৎ মোট ২২ দিন ইলিশ আহরণের পাশাপাশি এর মজুদ, পরিবহন এবং বেচাকেনাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এ নিষেধাজ্ঞা সফলভাবে কার্যকর করা হয়। উপকূলসহ দেশের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। মা-ইলিশ সংরক্ষণের এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন আশাতীত সফলতা লাভ করেছে। মৎস্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১১ দিন বন্ধ থাকায় ১ দশমিক ৬৩ কোটি ইলিশ আহরণ হতে রক্ষা পেয়েছে। এতে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৫ কেজি ডিম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত ডিমের শতকরা ৫০ ভাগ পরিস্ফুটনের হার ধরা হলেও ২ লাখ ৬১ হাজার ১০৩ কোটি রেণু উৎপাদন হয়েছে এবং এরমধ্যে শতকরা মাত্র দশ ভাগ বেঁচে থাকার হার ধরা হলেও ওই বছরে ২৬ হাজার ১০০ কোটি পোনা ইলিশে রূপ নিয়েছে। এভাবে প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মা-ইলিশ সংরক্ষণে সরকার দরিদ্র জেলেদের প্রতিও বিশেষভাবে সুনজর দিয়েছে। ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখায় গত বছর সরকার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭২৩ পরিবারকে ২০ কেজি হারে চাল বিতরণ করেছে। এ খাদ্য সহায়তায় দরিদ্র জেলেরা ব্যাপক উপকৃত হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচী সরকারের আরেকটি সাফল্যের উদাহরণ। প্রকৃতির নিয়মে ইলিশ স্বাদুপানি থেকে সমুদ্রের লোনাপানি আবার লোনাপানি থেকে স্বাদুপানিতে অভিপ্রয়াণ করে। ইলিশের লার্ভা নার্সারিক্ষেত্রগুলোতে ৬-১০ সপ্তাহ বিচরণের পরে জাটকা হিসেবে গভীর সমুদ্রে যাত্রা করে। আর এ সময়টাতে বিশেষ করে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ জাটকা জেলেদের শিকারে পরিণত হয়। তাই সরকার ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা নিধন বন্ধ ঘোষণা করেছে। যা যথাসম্ভব কার্যকর করাও হচ্ছে। জাটকা নিধনে জেলেদের নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিটি জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৪০ কেজি হারে চাল প্রদান করছে। এর ফলে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। ইলিশ শিকারি জেলেদের জীবনমান উন্নয়নেও নেয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। প্রকৃত জেলেদের একটি ডাটাবেজের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ এরইমধ্যে অনেকখানি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যেক জেলেকে দেয়া হয়েছে পরিচয়পত্র। মাছ ধরার বিরতিকালীন সময়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছ ধরারত অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোন কারণে মৃত্যু হলে ওই জেলের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা দেয়ার কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। যন্ত্রচালিত প্রতিটি নৌকা এবং ট্রলারকে নিবন্ধনের আওতায় নেয়া হচ্ছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে নেয়া হয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থ সহায়তায় মৎস্য অধিদফতর এবং ওয়ার্ল্ডফিস যৌথভাবে পাঁচ বছর মেয়াদী ‘ইকোফিস-বিডি’ নামের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে ইলিশের মজুদ, প্রজননকালীন সময়ে মা-ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব, ইলিশের অভিপ্রয়াণের ধরন নির্ণয়, মাছ ধরার পরিমাণ মনিটরিং ও অর্থনৈতিক জরিপসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে দরিদ্র জেলেদের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়নেও কাজ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের কারণেও ইলিশ খাতে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ইলিশ আহরণে সরাসরি পাঁচ লাখ জেলে জড়িত রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে পরোক্ষ জড়িয়ে আছে আরও ২৫ লাখ মানুষ। বর্তমানে জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক ভাগ হলেও এর পরিমাণ ক্রমে বাড়ছে। বাড়ছে অর্থের প্রবাহ। বেড়ে চলছে কর্মসংস্থান। যা নিঃসন্দেহে দেশের গোটা অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে তুলছে।
×