ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে আরও ঢলের আশঙ্কা জাতিসংঘের

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে দ্বিমুখী অবস্থানে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৮ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে দ্বিমুখী অবস্থানে মিয়ানমার

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার এখন দ্বিমুখী অবস্থান নিয়েছে। একদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়েছে। অপরদিকে প্রতিদিনই রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। এ কারণে রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুতে মিয়ানমারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে বাংলাদেশে আরও রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ । এছাড়া সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির দফতরের মন্ত্রী কিয়াতিন্ত সোয়ে গত সোমবার ঢাকা সফরে এসে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য উভয়পক্ষ একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়। বাংলাদেশ এখন এই ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে কাজ করছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থেমে নেই। মিয়ানমারের মন্ত্রী ঢাকায় এসে বৈঠকের পরও প্রতিদিনই বিপুল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। এসব রোহিঙ্গার ভাষ্য, তারা বাধ্য হয়েই সেখান থেকে চলে আসছেন। প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে চার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছেন। আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মতে বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন দুই হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির দফতরের মন্ত্রী কিয়াতিন্ত সোয়ের ঢাকা সফর শেষ হওয়ার পরই দ্রুত ওয়ার্কিং কমিটি গঠনে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। উভয়পক্ষ মিলে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই কমিটির সদস্যসংখ্যা হতে পারে ১০ থেকে ১৫। তবে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বলেছে, প্রতিদিন দুই হাজার করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে। এছাড়াও লাখখানেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা ফেরত প্রত্যাবাসন কতটুকু সফল হবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে যেন দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়তে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে বাংলাদেশ। সে কারণে দ্রুত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রক্রিয়ায় যেতে চায় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে উভয় দেশ একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছিল, সেটা ছিল ছোট পর্যায়ে। কেননা, তিন বছর আগের সেই পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশে এখন যে হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, অতীতে কোন সময়ই এই সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এছাড়া রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে উভয় দেশের। তাই অতীত অভিজ্ঞতা সামনে রেখেই দ্রুত ওয়ার্কিং কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় যেতে চায় বাংলাদেশ। রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মিয়ানমারের নেত্রী সুচি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না দেশটির সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোন সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেছেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সহিংসতা হয়েছে তা মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে রাখাইন এলাকায় মিয়ানমারে বিভিন্ন মিশনের ২০ কূটনীতিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে বিদেশী কূটনীতিকরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখতে পেয়েছেন। জাতিসংঘের আশঙ্কা ॥ রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার জেরে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার শঙ্কার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সফর শেষে জেনেভায় ফিরে গিয়ে সংস্থার মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে আবারও তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। মার্ক বলেন, এখনও রোহিঙ্গারা আসছে। ঢল থামেনি। আবারও তাদের ঢল নামার শঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘ সে হিসেবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তা জোয়েল মিলম্যান একটি পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রতিদিন দুই হাজার করে রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে আসছে। সব মিলিয়ে আরও লাখখানেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য সীমান্তে অপেক্ষা করছে বলেও জানাচ্ছে আইওএম। আইওএম বলছে, এখন পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সোয়া পাঁচ লাখ; যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি। অবশ্য বেসরকারীভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই। কোন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল সেখানে কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আহ্বান ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অচিরেই ফেরত নিতে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক। তিনি দেশটিতে মানবাধিকার যথাযথভাবে বজায় রাখার বিষয়েও মতামত দেন। তিনি বলেন, রক্তাক্ত রাখাইনে ত্রাণকর্মীদের ঢুকতে দিতে হবে। সেখানে যেন অবাধ বিচরণ সম্ভব হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি শুক্রবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। সেখান থেকে একটি যৌথ ঘোষণা জারি করা হয়। এতে সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত। কোফি আনানের প্রতিবেদনের পূর্ণ বাস্তবায়নই পারে সমস্যার সুরাহা করতে। ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, সেই আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা কেবলই বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়েই এর সমাধান টানতে হবে। দিল্লীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত সামিট শেষে যৌথ ঘোষণায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও ইইউ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জিন ক্লড জাঙ্কার স্বাক্ষর করেন। যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, সহিংসতার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দায় রয়েছে। তবে তারা অতি দ্রুতই যে কোন রকম সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানান। রাখাইনে যেন স্বাভাবিক দিন ফিরে আসে। সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে যেন কাজ করে মিয়ানমার। এছাড়া আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নেও জোর দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করছে তা সত্যিই বড় অবদান বলেও ঘোষণায় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
×