ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রির্পোটারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রির্পোটারের ডায়েরি

বঙ্গবন্ধুর চিঠির খোঁজে- ২০ আগস্ট, রবিবার। সকাল ১০টার দিকে পৌঁছেছি বাদুরা হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলটি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে। উদ্দেশ্য ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করা। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের একটি অংশ জুড়ে থাকছে ছাত্রলীগ-যুগলীগের নেতিবাচক নানা সংবাদ। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ইতিবাচক সংবাদ গণমাধ্যমে প্রায় নেই বললেই চলে। ঠিক সে সময়ে গলাচিপা উপজেলা ছাত্রলীগ একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। শোকের মাস আগস্টজুড়ে ছাত্রলীগ উপজেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ‘মেধা’ যাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিদিন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেধা যাছাই প্রতিযোগিতা। এটিকে ‘মেধা অন্বেষণ’ কর্মসূচীও বলা যেতে পারে। প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত একাধিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনী শেষে প্রামাণ্যচিত্রে পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে লিখিত পরীক্ষা ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কারের ব্যবস্থাও রয়েছে। মূলত এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পাঠ্য বইয়ের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জ্ঞানের বিস্তার ঘটছে। ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছে সমৃদ্ধ। ভবিষ্যত এ প্রজন্ম গড়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধের আলোয় আলোকিত হয়ে; এমন ভাবনা থেকে এলাকার সংসদ সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহাঙ্গীর হোসাইনের নির্দেশনায় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ গ্রুপভিত্তিক ভাগ হয়ে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। প্রথম থেকেই কর্মসূচীটি এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপচে পড়ছে শিক্ষার্থীদের ভিড়। এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও সাগ্রহে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। পর্যবেক্ষক হিসেবে এর আগেও ব্যক্তিগত আগ্রহে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শন শেষ হতে শিক্ষকদের অনুরোধে লাইব্রেরি কক্ষে গিয়ে বসেছি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আমখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক হারুন অর রশিদ দিলেন চমকে দেয়ার মতো একটি তথ্য। জানালেন, তার সংগ্রহে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা একটি চিঠি রয়েছে। রয়েছে পুরনো কিছু ছবি। যা তার চাচা পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জয়নুল আবেদীন শিকদার দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ওই চিঠি তার চাচার কাছে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে লিখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা চিঠির নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তখনই চিঠি ও ছবিগুলো দেখতে চাইলাম। হারুন ভাই বললেন, সেগুলো তার পটুয়াখালী শহরের বাসায় রয়েছে। আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। অনেক বুঝিয়ে হারুন অর রশিদকে নিয়ে ইজিবাইক রিজার্ভ করে ছুটলাম পটুয়াখালী দিকে। পথে পথে হারুন ভাই জানালেন, এর আগেও কয়েকজন সাংবাদিক তার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি কাউকেই ঐতিহাসিক ওই দলিলগুলো দেখাননি। বেলা আড়াইটার দিকে বাসায় পৌঁছেই দেখে নিলাম চিঠি ও ছবিগুলো। মোবাইল ফোনের ক্যামেরাতেই ছবি তুলে নিলাম। চিঠির অনেক জায়গা অস্পষ্ট। বায়ান্ন বছর আগের লেখা। অস্পষ্ট হবেই। তারপরেও অনেক শব্দ বোঝা যায়। বিশেষ করে চিঠির বিষয়বস্তু স্পষ্ট। আর তা হচ্ছে- নেতার সঙ্গে কর্মীর সম্পর্ক কতটা আন্তরিক আর গভীর হতে পারে, তার প্রমাণ এ চিঠি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বসে সংবাদপত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, জয়নুল আবেদীন শিকদার ন্যাপে যোগ দিয়েছেন। এতে বঙ্গবন্ধু উদ্বেগ প্রকাশ করে জয়নুল আবেদীনকে চিঠি লেখেন। নেতা কর্মীর কাছে চিঠি লিখছেন, এমন ঘটনা আজকের দিনে শুধু বিরল নয়, অনেকের ভাবনাতেই নেই। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহসহ অন্যান্য কাজ সেরে হারুন অর রশিদের বাসা থেকে যখন পথে নামি, তখন সন্ধ্যারাত ঘনিয়ে এসেছে। গলাচিপার উদ্দেশে যখন রিজার্ভ ইজিবাইকে উঠতে যাব, বয়োবৃদ্ধ হারুন ভাই জাপটে ধরলেন আমার হাত। বললেন, জীবনে আর কিছু চাই না। যদি এর ঐতিহাসিক মূল্য থাকে, তবে এ অমূল্য সম্পদগুলো কেবল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিজের হাতে তুলে দিতে চাই। রাত ৯টার দিকে বাসায় পৌঁছি। রাতেই এ প্রতিবেদনটি নিয়ে যখন কম্পিউটারের সামনে বসি, তখন শুধুই কানে বাজে হারুন ভাইয়ের আকুতি-আর কিছু চাই না। কেবল জননেত্রীর হাতে তুলে দিতে চাই। জানি না, হারুন ভাইয়ের এ আশা পূরণ হবে কি না। তবে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা বিরল একখানা চিঠি প্রত্যক্ষ করেছি, এটি অনেক বড় পাওয়া। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। -শংকর লাল দাশ জহুর আলীর সাহসিকতা ১৩ আগস্ট। রাত তখন তিনটা ২০ মিনিট। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নে ধরলা পারের কালুয়া গ্রামে ঘুমন্ত গ্রামবাসী কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তের মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। চারদিকে অন্ধকার চোখের সামনে ভেঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল ঘরবাড়ী। পানির প্রচন্ড- স্রোত। হু হু করে পানির শব্দ। চারদিকে মানুষের আত্মচিৎকার। গ্রামের পর গ্রামের মানুষ জোরে জোরে আল্লাহকে ডাকছেন। কেউ কেউ আজান দিচ্ছেন। গ্রামবাসী মনে করছে পানির স্রোতে কেউ আর বাঁচতে পারবে না। মানুষের গগন বিদারী চিৎকার আর শিশুদের কান্নায় সমস্ত আকাশ বাতাস ভারি হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়া, ছাটকালুয়া, জয়কুমোর, মেকলী ও কিং সিনাই গ্রামে পানির প্রচ- স্রোতে ঘর থেকে বের হয়ে শত শত পুরুষ, মহিলা আর শিশু বিভিন্ন মসজিদে এবং বাঁশঝারে আশ্রয় নিয়েছিল। অনেক শিশু, মহিলা, আর বৃদ্ধ গাছকে শক্ত করে ধরে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। কালুয়া গ্রামের পঞ্চাশ উর্ধ আছিয়া বেগমের চোখের সামনে তার ঘর স্রোতের কারণে একদম ভেঙ্গে গেল। সে পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে একটি বাঁশঝাড়ে বেহুশ হয়ে আটকা পড়েছিল। গ্রামবাসীরাই তাকে উদ্ধার করে। কালুয়া গ্রামে ধরলা নদীর ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাত তখন সাড়ে তিনটা। নিজের জীবন বাজি রেখে প্রচ- স্রোতে অন্ধকারের মধ্যে কালুয়া গ্রামের মাঝি জহুর আলী গ্রামের রাজ্জাক সর্দারের বড় নৌকা নিয়ে তিন চার জন মিলে গ্রামের মানুষদের উদ্ধারের কাজে নেমে পড়েছিল বিবেকের তাড়নায়। আর কেউ সাহস পায়নি এমন পরিস্থিতিতে। স্রোতের কারণে নৌকা যাচ্ছিল না। কিন্তু হারার মানুষ জহুর আলী নয়। সব বাধা অতিক্রম করে সেদিন সারারাত প্রায় তিন থেকে ৪শ’ মানুষ আর গরু-ছাগল বাঁধের ভাঙ্গা এলাকা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল উঁচু এলাকায়। এভাবে একসময় কখন ভোর হয়েছিল টেরও পায়নি। তারপর সকালের দিকে অনেক মানুষ নৌকা নিয়ে নেমেছিল মানুষ আর গরু-ছাগল উদ্ধারের কাজে। সেদিন কেন জানি জহুর আলীর মনে হয়েছিল সে সারা জীবন মানুষকে পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে। মানুষের বিপদে তাদের উদ্ধার করবে না এবং তাদের পাশে থাকবে না তা হতে পারে না। এই বোধ থেকে প্রথম দুর্যোগে তার যাওয়া। জহুর আলী জানেন না তিনি সেদিন এতগুলো নারী শিশু আর বৃদ্ধদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। একটু দেরি হলেই সেদিন হয়ত অনেক মানুষ ধরলার প্রবল স্রোতে ভেসে যেত। অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি হতো। সেদিন ঐ এলাকায় দুজন মানুষ প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। হয়ত জহুর আলী এই সাহসিকতার কাজের কোন পুরস্কার পাবেন না। মনেও রাখবে না কেউ। তারপরও হয়ত তার জীবনের সুখ স্মৃতির মাঝে বার বার শান্তি ফিরে পাবেন। তিনি গ্রামের এতগুলো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটাও বা কম কিসে। স্যালুট জহুর আলী। আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা আমাদের নেই। আপনি যেখানে থাকুন ভাল থাকুন। -রাজুমোস্তাফিজ
×