ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুরগির খাবারের দাম বেশি, ডিম বিক্রি করে টাকাই ওঠে না

কঠিন সঙ্কটে ক্ষুদ্র পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৩০ আগস্ট ২০১৭

কঠিন সঙ্কটে ক্ষুদ্র পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাসান সওদাগর। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার একজন ক্ষুদ্র পোল্ট্রি ব্যবসায়ী। মাত্র দুই হাজার মুরগি দিয়ে শুরু করেন তার লেয়ার পোল্ট্রি ব্যবসা। কিন্তু লোকসানের পরিমাণ গুনতে গুনতে সেই ব্যবসা এখন গুটিয়ে নিয়ে এসেছেন হাসান। জানালেন, খামার থেকে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩শ’ ডিম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু মুরগির খাবারে যা ব্যয় হয়, ডিম বিক্রি করে সেই টাকাই ওঠে না। ওষুধ ও কর্মচারীর বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো আলাদা। মূলত ডিমের স্বল্প মূল্যে এই ব্যবসায়িকে অনেকটা খালি হাতেই ব্যবসা গুটাতে হয়েছে। হাসানের মতো দেশে বর্তমানে এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। অস্বাভাবিক হারে ডিমের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে হাজার হাজার খুদে পোল্ট্রি খামারি সর্বস্বান্ত হতে চলেছেন। একদিকে ডিমের দাম কমেছে অস্বাভাবিকভাবে। অন্যদিকে গত বাজেটের পর মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে। ফলে খামারিরা পড়েছেন বিপাকে। গত ৭-৮ মাস ধরেই চলছে এই অবস্থা। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। বাকিরাও চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে নতুন কোন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগ করবেন না এবং আগামী কিছুদিনের মধ্যে দেশে ডিমের সঙ্কট দেখা দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। একাধিক পোল্ট্রি খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে খামারিদের ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে চার টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ টাকায়। খামার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেই ডিম কিনে বিক্রি করছেন সাড়ে ৭ থেকে ৮ টাকায়। অথচ বিনিয়োগের হিসাব ধরে প্রতি ডিমের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছ সাড়ে ৬ টাকা। একজন পোল্ট্রি ব্যবসায়ী প্রতি ডিমে লোকসান গুনছেন দেড় থেকে দুই টাকা। অন্যদিকে খামার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ে নিচ্ছেন ডিমপ্রতি আড়াই থেকে তিন টাকা। এই পরিস্থিতিতে খামারিরা পথে বসছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে একদিকে ডিমের দাম কমেছে, অন্যদিকে নতুন ট্যাক্সের কারণে বেড়েছে মুরগির খাবারের দাম। একই সঙ্গে বেড়েছে মুরগির বাচ্চার দামও। ওষুধের দাম, কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ তো দিন দিন বাড়ছেই। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্র পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার কোন সুযোগই নাই। বড় বড় পোল্ট্রি শিল্পের মালিকদের অবশ্য এই ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। তারা নিজেরাই খুচরা বাজারে ডিম বাজারজাত করছেন। মুরগির খাদ্য তাদের শিল্পে উৎপাদন হয়। মুরগির বাচ্চাও তারাই উৎপাদন করেন। মুরগির খাবার এবং বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিয়ে তারা ডিমের দাম পুষিয়ে নিতে পারছেন। পোল্ট্রি শিল্প সমিতির হিসাব মতে, বর্তমানে সপ্তাহে উৎপাদিত ডিমের পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই কোটি। সে হিসেবে সপ্তাহে খামারিদের লোকসানের পরিমাণ ৪ কোটি টাকা। গত পাঁচ মাসে অন্তত ৮০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছেন পোল্ট্রি খামারিরা। তারা বলছেন, চার-পাঁচ মাস আগেও তাঁরা খামারে বসে ৭ টাকায় প্রতি ডিম বিক্রি করেছেন। গত কয়েক মাসে ক্রমাগত ডিমের দাম কমায় এখন তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। বড় পোল্ট্রি শিল্প, ডিমের বাচ্চা উৎপাদনকারী, খাবার উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী সবাই লাভ করছেন। লোকসান গুনতে হচ্ছে ডিম উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র খামারিদের। আড়তদাররা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বাজারে ডিমের সরবরাহ বেশি। তাই দাম ওঠানামার মধ্যে আছে। ডিমের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় সম্প্রতি রাজশাহীতে মহাসড়কে বিপুল পরিমাণ ডিম ভেঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়েছেন পোল্ট্রি খামারিরা। মুরগির বাচ্চা, খাবার ও ওষুধের দাম কমানোর দাবিতে তারা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এগ প্রডিউসারস্ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের কিছু বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি ব্যবসা। আমরা ক্ষুদ্র খামারিরা এখন কোণ্ঠাসা। তিনি বলেন, আমরা প্রতিপিস সাদা ডিম বিক্রি করছি ৫ টাকা ২০ পয়সায়। তাহলে কিভাবে আমরা টিকে থাকব। সরকার যদি ক্ষুদ্র খামারিদের প্রতি নজর না দেয় তাহলে পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষুদ্র খামারিরা টিকে থাকতে পারবে না। পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বলা হয়। দেশে প্রাণিজাত প্রোটিনের বড় যোগানদাতা পোল্ট্রি শিল্প। তথ্য অনুযায়ী, ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ প্রোটিনেরই যোগান আসে পোল্ট্রি থেকে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ডিম উৎপাদন ছিল ৫৩৭ কোটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৯১ কোটিতে। বর্তমানে সপ্তাহে উৎপাদিত ডিমের পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই কোটি। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আর মাংস উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ১৮শ’ টন। দেশের চাহিদার নিরিখে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে দ্বিগুণ বিনিয়োগ করতে চান পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা। নানা সঙ্কট ও সমস্যা এ খাতের বিনিয়োগের প্রধান বাধা বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। বিদেশী পুঁজি আসার কারণে দেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা চলছে। বড় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র খামারিরা। জানা যায়, পোল্ট্রির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হলো ডিমের খামারমূল্য, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং পোল্ট্রি খাবার। কোন ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সংক্রান্ত নীতিমালা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাজারে কখনও কখনও ব্রয়লার মুরগির একদিনের বাচ্চার দাম থাকে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। আর লেয়ারের বাচ্চা খামারিদের কিনতে হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। অথচ এক হিসেব থেকে দেখা যায়, ব্রয়লারের একদিনের বাচ্চার উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। লেয়ারের বাচ্চার উৎপাদন খরচও ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ক্ষদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিনগুণ দামে। জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে ছোট ও মাঝারি ধরনের অসংখ্য খামার। এতে খামারিরা পথে বসার পাশাপাশি কাজ হারিয়েছে অনেক শ্রমিক। খামার পরিচালনার খরচ বেড়েছে। কমেছে মুনাফা। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ীতে পোলল্ট্রি খামার আছে হাসিবুর রহমানের। তিনি বলেন, হ্যাচারিতে লেয়ার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করতে খরচ হয় ২৫-৩০ টাকা। সরকারের তদারকি না থাকায় অনেক সময় সেই মুরগির বাচ্চা কিনতে হয় ১২০-১৩০ টাকা পর্যন্ত। এতে করে খামারিদের ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তিনি বলেন, এখন ডিম বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায়, সেই টাকা দিয়ে মুরগির খাবারই পুরোপুরি কেনা যাচ্ছে না। রাজশাহী পোল্ট্রি, ফিশ ও ক্যাটল ফিড ডিলার এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, গোটা জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে এক লাখের মতো পোল্ট্র্রি খামার আছে। যার মধ্যে পাঁচ হাজারের মতো খামারে ডিম উৎপাদিত হয়। খামারিরা বলছেন, এই খাতে সরকারের তেমন কোন নজরদারি নেই। সুষ্ঠু নীতিমালা না থাকার কারণে হ্যাচারির মালিকেরা ইচ্ছামতো বাচ্চার দাম রাখছেন। খাবার উৎপাদনকারীরা লাভের হিসাব ঠিক রেখেই উচ্চমূল্যে খাবার বিক্রি করছেন। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা। এই পরিবেশে বড় খামারিরা কিছুটা লাভ করতে পারলেও ছোট খামারিরা টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ রাজশাহী শাখার সভাপতি মাহফুজুর রহমান বলেন, পোল্ট্রি খামারে লাভের আশায় প্রচুর মানুষ ছোট ছোট খামার দিয়েছে। এ বছর ডিমের উৎপাদনও ভাল হয়েছে। বাজারে প্রচুর ডিমের সরবরাহ। হুট করে ডিমের দাম কমে যাওয়ায় খামারিরা বিপাকে পড়ে গেছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফায়েজ রাজা চৌধুরী বলেন, সরকার ২০১৪ সালে যখন একদিনের ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ৩২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। পরে তা হাইকোর্টে রিট করে স্থগিত করা হয়। তখন প্রাণিসম্পদ অধিদফতর তাদের হিসেবে একদিনের ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ দেখিয়েছিল ২৪ টাকা। তিনি বলেন, গত এক বছরে এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কমপক্ষে ২০ থেকে ২২টি সভা হয়েছে। এর কোন সুরাহা হয়নি। দেশের পুষ্টি চাহিদা মিটাতে হলে এই ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সরকার অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ট্যাক্স মওকুফ ও নামমাত্র ট্যাক্স ধরে এই শিল্পকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন। এখন তদারকির মাধ্যমে খামার পর্যায়ের ডিম ও মুরগির মূল্য করতে হবে। হ্যাচারিতে বাচ্চার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নজর রাখতে হবে মুরগির খাবার ও ওষুধের দামের দিকে। না হলে এই শিল্প ধ্বংস হতে বাধ্য।
×