ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক শ’ স্পটে চক্রের ৪শ’সদস্য সক্রিয়

অজ্ঞান ও মলম পার্টির টার্গেট এখন পশুর হাট

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ৩০ আগস্ট ২০১৭

অজ্ঞান ও মলম পার্টির টার্গেট এখন পশুর হাট

শংকুর কুমার দে ॥ পশুর হাটকে টার্গেট করেছে অজ্ঞান ও মলম পার্টি। এ চক্রের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে গরু ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ। সর্বস্ব কেড়ে নিতে মারাত্মক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ ধরনের অপরাধী চক্রের সদস্যরা। রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় প্রায় ১শ’ স্পটে ৩০টি চক্রের চার শতাধিক সদস্য তৎপর ও সক্রিয়। এ চক্র এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, গত ২৪ ঘণ্টায় কেবলমাত্র রাজধানীতেই তাদের হাতে এক ব্যক্তি নিহত ও চার ব্যক্তিকে অজ্ঞান অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে। পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় অজ্ঞান ও মলম পার্টির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিএমপি সূত্র জানায়, প্রতি বছরই ঈদ মৌসুম সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই তৎপর হয়ে উঠে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। এবারের পবিত্র ঈদ-উল-আযহা ঘিরে তাদের প্রধান টার্গেট এখন পশুর হাট। এছাড়া বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনসহ প্রায় ১শ’ স্পটেও এদের প্রশিক্ষিত সদস্যরা সক্রিয়। কাজের বুয়া, ভাড়াটিয়া সেজে বাসাবাড়িতেও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। র‌্যাব-পুলিশের বিশেষ অভিযানে অজ্ঞান পার্টি চক্রের কিছু সদস্য সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর আবার জামিনে মুক্ত হয়ে তৎপর হচ্ছে। এ চক্রের টার্গেট করা ব্যক্তিদের কখনও যাত্রী, কখনও হকার আবার কখনও সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা-ভাড়াটিয়া বেশে নানা কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগসহ সব লুটে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এসব চক্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। এবারের ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতা এতটাই ভয়াবহ যে, গত রবিবারও মারা গেছেন ফজলুল কবির নামে আনুমানিক ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। ফজলুল কবিরকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। গত ২৪ আগস্ট সায়েন্সল্যাব থেকে মিরপুরগামী বাহন পরিবহনের ভেতরে পরিচয়হীন অবস্থায় ফজলুল কবির প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। ঢামেকে নেয়ার পর গত রবিবার রাত ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সনদে চিকিৎসক উল্লেখ করেছেন বিষক্রিয়ায় ফজলুল কবিরের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অজ্ঞান ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়া বেশিরভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগী বা তার স্বজনরা মামলা দূরে থাক, অনেক সময় পুলিশকে তথ্যগত সহযোগিতাও দেন না। এ ধরনের অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। তাই আইনের ফাঁক গলে তারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে আবারও তৎপর হয়েছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে ঢাকার ৪৯ থানার ওসির প্রতি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে ডিএমপি সদর দফতরের। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা সংঘবদ্ধ। এসব চক্রের সদস্যরা তাদের অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে। তারা কখনও যাত্রী, কখনও হকার আবার কখনও সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতার বেশে মিশনে অংশ নেয়। কখনও কখনও তারা চেতনানাশক পাউডারমিশ্রিত রুমাল ঝেড়ে শ্বাস-নিশ্বাসের মাধ্যমেও যাত্রীকে অচেতন করে। মাঝেমধ্যে তারা অচেতন যাত্রীকে নিজেদের আত্মীয় পরিচয় দেয়। হাসপাতালে নেয়ার নাম করে গাড়ি আনার কথা বলে দ্রুত পালিয়ে যায়। রাজধানীর আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো ছাড়াও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা গুলিস্তান, সদরঘাট, ফুলবাড়িয়া, মগবাজার, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, রামপুরা, বনানী, আরামবাগ, ফার্মগেট, আসাদগেট, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, ফকিরাপুল বাজার, দৈনিক বাংলা মোড়, আরামবাগ দেওয়ানবাগ শরিফের পাশে, মতিঝিল, মিরপুর, খিলগাঁও এলাকায় বেশি তৎপর। এসব অপরাধী চক্র অটোরিক্সা, রিক্সা ও ট্যাক্সিক্যাব চালকদের যোগসাজশে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছে। ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হওয়া অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা জানিয়েছে, রাজধানীতে সক্রিয় আছে এমন অজ্ঞান ও মলম পার্টি চক্রের অন্যতম সদস্য হলো আহসান আলী, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, আব্দুল সালাম, শেখ আবু জাফর, জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ শহিদুল ইসলাম ওরফে বাবু, বোরহান শেখ, রফিজ শিকদার, মিন্টু শিকদার, শফিকুল সমাদ্দার, মিল্টন শিকদার, হুমায়ুন, আনোয়ার হোসেন, এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, মাওলা, রিপন মৃধা, ফজলুর রহমান প্রমুখ। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, অজ্ঞান ও মলম পার্টি চক্রের সদস্যরা সারাবছরই সক্রিয় থাকালেও বিশেষ করে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা ও ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে তৎপরতা বেড়ে যায়। অজ্ঞান ও মলম পার্টির রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভুক্তভোগীরা। অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে কোনোকিছু না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এসব চক্রের বেশকিছু সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে সব ধরনের অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে আটক ১ স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, গজারিয়ায় অজ্ঞান পার্টির এক সদস্যকে আলামতসহ আটক করেছে পুলিশ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আনারপুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্যসহ আটক করা হয় ওই সদস্যকে। এসময় অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে আহত অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে গজারিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আটককৃতের নাম মোঃ রিপন মিয়া (২৩)। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে কনস্টেবল রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে তাজিমুল ইসলাম নামে এক পুলিশ সদস্য সর্বস্ব খুইয়েছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ পূর্ব বিভাগে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। বছিলা পশুর হাট থেকে অজ্ঞান পার্টির ৬ সদস্য গ্রেফতার রাজধানীর বছিলা কোরবানির পশুর হাট থেকে অজ্ঞান পার্টির ছয় সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে র‌্যাব-২ এর একটি দল মোহাম্মদপুরের বছিলা কোরবানির পশুর হাট থেকে অজ্ঞান পার্টির সদস্য মোঃ জাকির হোসেন (২৪), মোঃ রুবেল মিয়া (২৪), মোঃ কামাল হোসেন (৩৫), মোঃ তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তপন (৩০), মোঃ রাসেল মৃধা (২৪) ও মোঃ সজিব আহমেদকে (২২), গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে চেতনানাশক ওষুধ, মলম, মরিচের গুঁড়া উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা কোরবানির পশুর হাটে হকার সেজে পশু বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতদের ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ ও মলম মিশিয়ে খাইয়ে দেয়। অচেতন হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
×