ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামের এক আমেনার গল্প

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রামের এক আমেনার গল্প

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সচ্ছল এবং সম্পন্ন গৃহস্থ আলহাজ আমীর হোসেন ও সাবেরা বেগমের কন্যা আমেনা। মানুষের জীবন বিচিত্র আর জটিল। আর এই বিচিত্রতার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া আমেনার জীবন চলে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের টানাপোড়েনের মধ্যে। মাত্র ১২ বছর বয়সে নিকটাত্মীয় (খালাত ভাই) রফিক আহমেদের সঙ্গে বিয়ে হয় আমেনার। কিশোরী বয়সে অনেক স্বপ্নের জাল বুনে স্বামীর সংসার করতে আসা আমেনার জীবন সংসারের ঝড় ঝাপটায় একেবারে বিপন্ন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের রক্ষণশীলতা, বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামি সর্বোপরি নারী হিসেবে অসহায়ত্ব যে কোন পর্যায়ে গৃহবধূর জীবন অসহনীয় করে তোলে তা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে মর্মান্তিকও। স্বামীর কাছ থেকে সব ধরনের অধিকার হরণের ব্যাপার তো আছেই পাশাপাশি শাশুড়ি কর্তৃক আঘাত-নির্যাতনের বিষয়টিও একজন কিশোরীবধূকে নির্মমতার শৃঙ্খলে আটকে দেয়। সিংহভাগ সাধারণ মেয়েরা সংসারের এই যন্ত্রণাকে মুখ বুজে সহ্য করে পরিবারে টিকে থাকে সন্তানের মঙ্গল আর ভবিষ্যত নিশ্চয়তার কথা ভেবে। কিন্তু আমেনা সে ধাঁচের মেয়েই নয়। অল্প বয়স থেকেই তার চরিত্রে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসা তেজ, জেদ আর আত্মবিশ্বাস তাকে ভিন্নমাত্রার জীবন সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়। ১৪ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হওয়া আজও জীবনের এক স্মরণীয় অনুভূতি। সেই স্বাপ্নিক আবেগের রেশ কাটতে না কাটতেই পরের বছর কোলে আসে দ্বিতীয় সন্তান। দুই সন্তানই তার মেয়ে। এ নিয়ে আজও আমেনা কোন আফসোস কিংবা প্রত্যাশা নেই। ছেলের আকাক্সক্ষা থাকলেও কন্যা সন্তানদের সে কখনই অবহেলা করেনি। সংসার শুরু থেকেই অত্যাচার আর অবিচারের মাত্রা থাকলেও দু’সন্তানের জন্মের পর তা আরও বেড়ে যেতে থাকে। স্বামী-শাশুড়ির নিত্য কলহ বিবাদের পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি নিবিড় মমতায় আবিষ্ট আমেনা এখন একেবারেই দিশেহারা। স্বাধীনচেতা আমেনা কখনও সেভাবে নির্যাতন আর নিপীড়নকে মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে প্রতিপক্ষ হয়ে স্বামী-শাশুড়ির সঙ্গে লড়াই করেছে। ইতোমধ্যে স্বামী নতুন করে আরও একটি সংসার গোছাতে চায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিয়েতে আগ্রহী রফিক শেষ পর্যন্ত সন্তানসহ আমেনাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে আসে। এর পরেও তাকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে তার শ্বশুরবাড়ি। কারণ এক পর্যায়ে তার মেয়েদেরও নিজের কাছে রেখে দেয় তাদের বাবা। নিঃসঙ্গ, একাকী আমেনা উদ্দেশ্যহীনভাবে জীবন কাটাতে গিয়ে এক সময় মনে করে এই পটুয়াখালীর বাইরে যদি কোথাও চলে যাওয়া যেত তাহলে বোধহয় ভালই হতো। স্বামী-সন্তানের কাছ থেকে যখন আলাদাই হয়ে গেল তাহলে আরও দূরে চলে গেলে হয়ত জ্বালাটা কমতেও পারে। এরই মধ্যে খবর আসে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের। আবার সেই সংসারে তার নিজের দুই কন্যা সন্তান। সব মিলিয়ে আমেনা তার বিড়ম্বিত জীবনকে কঠিন ব্রত নিয়ে সামনে পথ চলার সন্ধান খুঁজতে থাকে। এদিকে ভাইরা রাজি থাকলেও বাবা বিয়ে হয়ে যাওয়া কন্যাকে বাড়িতে রাখতে ঘোরতর আপত্তিও জানায়। দৃঢ়চেতা আমেনা এক সময় নিজের গন্তব্য নিজেই ঠিক করে নেয়। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছেড়ে অজানা-অচেনা ঢাকা শহরে নিজের জায়গা করার সঙ্কল্পে রাজধানীর বুকে নিজেকে সমর্পণ করে। সেই ১৯৯৪ সালের কথা। শেষ আশ্রয় হিসেবে এক আত্মীয়ের বাসায় নিজের নতুন জীবন শুরু করে। ইতোমধ্যে দুই মেয়ে বড় হতে থাকে। তাদের বাবা আর বিমাতার কাছে। তবে একটা ব্যাপার সব সময়ই লক্ষ্য করা যেত যে আমেনার কখনই মনে হতো না তার মেয়েরা কষ্ট পাচ্ছে কিংবা খারাপ আছে। বাবার কাছে তারা লেখাপড়াও কিছুটা শিখতে পেরেছে। গ্রাম্য রীতি অনুযায়ী মেয়েদেরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে মেয়েদের জীবন নতুনভাবে পরিপূর্ণ হয়। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় মেয়েরা তার মায়ের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে। কয়েক বছর পর সন্তানদের কাছে পেয়ে আমেনার জীবনও কানায় কানায় ভরে ওঠে। যে আত্মীয়ের বাসায় আমেনাকে নিজেকে গুছিয়ে নেয় সেখানেও সে যথার্থ সম্মান নিয়ে তার অবস্থান শক্ত করতে বেশি সময় লাগেনি। কাজকর্মের নৈপুণ্যতায় সবার নজর কাড়তে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এক সময় সে তার আত্মীয়ের বাসায় অভিভাবকের মর্যাদায়ও আসীন হয়। এভাবে পার হয়ে যায় সুদীর্ঘ ২২ বছর। সুখে, দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে জীবনের এই পথ পরিক্রমা পাড়ি দিতে দিতে সে যখন ক্লান্ত, অবসন্ন তখন মেয়েরা স্থির করে এবার তাদের মাকে তারা নিয়ে আসবে। এদিকে যাদের বাসায় এত বছর কাটাল তারাও আমেনার মতো একজন অভিভাবককে হারাতে রাজিই হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমেনা আবার ফিরে এলো সেই তার নিজের গ্রামের সীমানায় সাতকানিয়াতে। সেই চিরচেনা গ্রামের নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতি এক অন্য রকম আনন্দে ভরিয়ে তোলে। বয়স এখন ষাটের কোঠায়। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় মেয়েদের কাছে পাওয়ার যে তৃপ্তি আর পরিপূর্ণতা যা তার অনেক আগেই পাওয়ার কথা ছিল তা আজ তাকে এক বিরল মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। বাকি জীবনটা সে তার সন্তান আর নাতি- নাতনিদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে চায়। সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম তাকে নতুন করে চমক দেয়, অন্য রূপে নিজের গ্রামকে দেখে সে আনন্দে আত্মহারা। যে গ্রাম সে রেখে গিয়েছিল সে গ্রামে এখন নতুন যুগের হাওয়া, আধুনিকতার সমস্ত উপকরণে পুরো গ্রামটি সাজানো, গোছানো। ফলে ঢাকা শহরের অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল, বাড়ি ছেড়ে সাতকানিয়ার গ্রামীণ পরিবেশে থাকতে তার মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। গ্রাম যেন এখন নতুন রূপে শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×