ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত রিপোর্ট পেশ

যান্ত্রিক ত্রুটিই বয়লার বিস্ফোরণের কারণ ॥ ২০ সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৪ জুলাই ২০১৭

যান্ত্রিক ত্রুটিই বয়লার বিস্ফোরণের কারণ ॥ ২০ সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ওই কমিটি কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পেছনে সাত কারণ চিহ্নিত করেছে। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় দুর্ঘটনা না ঘটে এবং কোন প্রাণের ক্ষতি না হয় সেজন্য জন্য ২০টি সুপারিশসহ একটি রূপরেখা এ প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বৃহস্পতিবার তার ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাংবাদিকদের জানান, গত ৩ জুলাই সন্ধ্যায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় বয়লারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানার একটি চারতলা ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার দুই পাশের দেয়াল ধসে পড়ে এবং দরজা-জানালা ও মেশিনপত্র উড়ে যায় এবং দুমড়ে মুচড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এবং বিস্ফোরিত বয়লারের টুকরোর আঘাতে কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছে এবং ৭০ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্তের জন্য ঘটনার দিনই গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটি বুধবার বিকেলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এছাড়াও ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের গঠিত ওই কমিটি তদন্তকালে বয়লার বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং ২৯ জনের জবানবন্দী গ্রহণ করে ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করে। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় দুর্ঘটনা না ঘটে এবং কোন প্রাণের ক্ষতি না হয় সেজন্য ২০টি সুপারিশসহ একটা রূপরেখা এ প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে জানান, কারখানার ওই কক্ষে দুটি বয়লার ছিল। এর মধ্যে একটি ১০ টনের এবং অপরটি পাঁচ টনের। ঘটনার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পাঁচ টনের ছোট বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়েছে। বিস্ফোরণে পার্শ্ববর্তী ১০ টনের বয়লারটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত বয়লারের সেপটিক ভাল্বের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়। ১৯৯৬ সালে জার্মানির অমনিকা কোম্পানির তৈরি বয়লারটি ঘটনার সময় কারিগরিভাবে একদম নিখুঁত ছিল এটা বলা যাবে না। ১৯৯৮ সালে ইউরোপ এশিয়াটিক কোম্পানি কর্তৃক বয়লারটি স্থাপন করা হয়েছিল। যার রেটিং ছিল ৯৬৮ বর্গফুট। বয়লারটি প্রথম ২০০৩ সালের ১০ জুন বয়লার পরিদর্শক কর্তৃক পরিদর্শন করা হয় এবং রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। সর্বশেষ প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট ১০ বারে এ বছর ২৪ জুন পর্যন্ত চালানোর অনুমতি প্রদান করে। বিস্ফোরণের দিন বয়লারটির রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও বয়লারের আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে এমনি বলা যাবে না। যে কক্ষে বয়লারটি ছিল তার কাঠামোগত বা দেয়াল সুরক্ষিত ছিল না। প্রতিবেদনে প্রতিটি ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। বয়লার বিস্ফোরণের পাঁচটি কারিগরি ও দুটি প্রশাসনিক ত্রুটি ও দুর্বলতা ছিল বলে তদন্ত কমিটি মনে করছে। এগুলো হলোÑ বয়লারের প্রেসার গেজ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ডেলিভারি লাইন বন্ধ থাকা, লিভারটিতে শ্লট না কাটা, অপারেটর কর্তৃক প্রেসার রিলিজ করতে ব্যর্থ হওয়া, বয়লার মেনটেন্যান্স কর্তৃপক্ষের বয়লার অপারেটরদের তদারকের অভাব, অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। ঘটনার সময় লিভারটিতে শ্লট কাটা না থাকায় বয়লারের কম্পনে ডেড ওয়েট উচ্চচাপের দিকে সরে গিয়ে ওভার প্রেসার সিচুয়েশন তৈরি হয়েছিল। ঈদের ছুটির পর কারখানাটি ৪ জুলাই চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারখানার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ৩ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে কারখানার বয়লার চালু করা হয়েছিল। তাই এ ঘটনার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনে বয়লার অপারেটরদের দায়ী করা হয়। আবার বয়লার অপারেটরদের সঠিকভাবে তদারকি না করায় ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ওই প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, তদন্ত কমিটি ২৮ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করে। এর সঙ্গে ৯১ পৃষ্ঠা সংযুক্তি দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি ওই প্রতিবেদনে ২০টি সুপারিশ দিয়েছে। এতে বিদ্যমান বয়লার অপারেটর নিয়োগ আইন (বয়লার এটেনডেন্ট রুলস ১৯৫৩) সংশোধন করে বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা লেভেল করা, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিল্পঘন এলাকায় বয়লার টেস্টিং ল্যাব স্থাপন ও সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান/সংস্থা থেকে বছরে একবার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান বয়লার আইন ১৯২৩ সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ যুগোপযোগী করার সুপারিশও দেয়া হয়েছে। এসব সুপারিশে উন্নত বয়লার নির্মাণ ও বয়লারের ক্ষতি সুরক্ষিত করণসহ যথাযথ তদারকের কথা বলা হয়েছে। বয়লার বিস্ফোরণের এ ঘটনায় কারখানার প্রায় ৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির ২০ সুপারিশ প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্টিম কনজামশন ক্যাপাসিটি অনুযায়ী দেড়গুণ স্টিম প্রোডাকশন ক্ষমতাসম্পন্ন বয়লার ক্রয় করা এবং ডেড ওয়েট সিস্টেম বয়লার সেফটি ভাল্ব প্রতিস্থাপন করে স্পিং লোডেড/আধুনিক সেফটি ভাল্ব স্থাপন করা, চার ঘণ্টা অগ্নিপ্রতিরোধক ইট দিয়ে দেয়াল নির্মাণ এবং দুই ঘণ্টা অগ্নিপ্রতিরোধক দরজা স্থাপন করা। বয়লার রুম ম্যানুয়াল অনুয়ায়ী নির্মাণ করা। অনুমোদিত প্রেসারে বয়লারের সেফটি ভাল্বের সেটিং প্রেসার নিশ্চিত করা। বয়লার ওভার হেডর উপরে ছয় ফুট ফাঁকা রেখে আরসিসি ছাদ নির্মাণ করতে হবে। সাতদিনে একবার সেফটি ভাল্বের প্রেসার চেকআপ এবং সেফটি ভাল্বের সেফটি ভাল্ব ব্লো-আপ চেক করা, ব্লো-ডাউন-ভাল্ব মাসে একবার চেক করা। প্রতিবছর একবার হাইড্রোস্টাটিক ও হ্যামার টেস্ট করা, স্বল্প শিক্ষিত/অশিক্ষিত বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম দুইমাসের একটি নিবিড় থিউরি এবং প্রাকটিকেল প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, কারখানায় ন্যূনতম একজন বিএসসি প্রকৌশলী নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা এবং বয়লার বন্ধ ও চালু করার সময় প্রকৌশলীর উপস্থিত নিশ্চিত করা ও তার লিখিত প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক থাকা। বয়লার, জেনারেটর, টারবাইন, কেমিক্যাল গোডাউনসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের নিরাপত্তা তদারকি মালিক নিজে বা তার নিজস্ব তত্ত্ববধানে সম্পন্ন করা। বয়লার ও টারবাইন তদারকির জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন, বিদ্যমান বয়লার আইন ১৯২৩ সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে যুগোপযোগী করা, বিদ্যমান বয়লার অপারেটর নিয়োগ আইন (বয়লার এটেনডেন্ট রুলস ১৯৫৩) সংশোধন করে বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা লেভেল করাসহ ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে।
×