ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সুধীন দাশের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩০ জুন ২০১৭

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সুধীন দাশের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সঙ্গীতের সাতটি স্বরের সাধনায় কেটে গেল দীর্ঘ এক জীবন। সুরের আশ্রয়ী সেই জীবনের পাথেয় হয়েছে নজরুলসঙ্গীত থেকে শুরু করে লালন সাঁইয়ের গান। অমূল্য সেই সম্পদকে তুলে দিয়েছেন সঙ্গীতানুরাগী শিক্ষার্থীদের মাঝে। সব মিলিয়ে সঙ্গীতকে ঘিরেই যেন গড়ে উঠেছিল সুধীন দাশের সংসার। সেই সুবাদে এই সঙ্গীতজ্ঞের বিদায় যাত্রায় নিবেদিত হলো প্রাণভরা ভালবাসা। চোখের জলের সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে জানানো হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী থেকে শুরু করে নবীন-প্রবীণ গায়ক-গায়িকার পাশাপাশি অভিনয় শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ শিল্পের নানা ভুবনের মানুষের সঙ্গে গুণগ্রাহীদের ভালবাসায় চিরবিদায় নিলেন এই শিল্পী। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও নজরুল ইনস্টিটিউটে দুই দফা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে পোস্তগোলা মহাশ্মশানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় নজরুল ও লালনের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়নকারী সুধীন দাশের। উপমহাদেশের বরেণ্য এই নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষককে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো শিল্পী-সংগঠকরা বললেন, সঙ্গীতজ্ঞ সুধীন দাশের কর্মকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে। প্রেরণা নিতে হবে সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত তার আদর্শিক জীবন থেকে। মঙ্গলবার রাতে এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সুধীন দাশ। এরপর শিল্পীর শবদেহ রাখা হয় হাসপাতালের হিমাগারে। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সকালে তার মরদেহ প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের বাসায়। পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভালবাসা নিবেদন শেষে নিয়ে আসা হয় ধানম-ির নজরুল ইনস্টিটিউটে। সঙ্গে ছিলেন তার মেয়ে সুপর্ণা দাশ ও জামাতা হাসান মাহমুদ স্বপন। মরদেহ গ্রহণ করেন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম ও নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে সুধীন দাশকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন আজাদ রহমান, শাহীন সামাদ, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, ফেরদৌস আরা, ইয়াসমীন মুশতারী, বুলবুল মহলানবীশ, সালাউদ্দিন আহমেদসহ সুধীন দাশের শিষ্য ও অনুরাগীরা। এদেশে নজরুলসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে এই সঙ্গীতজ্ঞের অবদানের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুলের বিকৃত সুর রোধে সুধীন দাশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নজরুলের আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে নজরুলের সুর উদ্ধারে তিনি আমরণ কাজ করে গেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় অবদান। প্রথম জীবনে রবীন্দ্র, নজরুল, অতুলপ্রসাদের গান গাইলেও পরে তিনি নজরুলসঙ্গীতের বিকৃতি রোধে শুধুমাত্র নজরুলসঙ্গীতে মনোনিবেশ করেন। আজাদ রহমান বলেন, নজরুলসঙ্গীতের নানা বিকৃতি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। সেখানে পথ দেখাবেন সুধীন দাশ। ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, নজরুলের গানের অথেনটিক প্ল্যাটফর্ম দিয়েছেন সুধীন দাশ। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সহজ নোটেশন তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন বটবৃক্ষ। শাহীন সামাদ বলেন, তিনি চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু আমাদের একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেল। নজরুল ইনস্টিটিউটে শ্রদ্ধা জানানোর পর সুধীন দাশের শবদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে এখানে সর্বসাধারণের পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান শ্রদ্ধা জানান। প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠন হিসেবে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে শিল্পকলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, উদীচী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংসদ, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পিতসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবে শিল্পীদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, লাইসা আহমেদ লিসা, বুলবুল ইসলাম, শারমিন সাথী ইসলাম, নাট্যজন মামুনুর রশীদসহ অনেকে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, পশ্চিম বাংলায় একবার নজরুলের সুর নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা গেল, তখন সেখানকার এক সঙ্গীতগুরু সবাইকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, তোমরা সুধীন দাশের স্বরলিপি অনুসরণ কর। এটা তার কাছে বড় প্রাপ্তি কিনা জানি না, তবে এটা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। নজরুলসঙ্গীতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। বাংলার সঙ্গীতভুবনের পুরোধা সুধীন দাশ আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, সুধীন দা’র সঙ্গে কারও কোন বিরোধ ছিল না। তিনি যা পেয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তার কোন আকাক্সক্ষা ও ক্ষোভ ছিল না। সুবীর নন্দী বলেন, নজরুলের গানের স্বরলিপি প্রণয়নের কারণেই শরীরিকভাবে না থাকলেও মননে চিরস্থায়ীভাবে বেঁচে থাকবেন সুধীন দাশ। নজরুলের গানের স্বরলিপি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসানও ঘটিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তার জীবনাচারণও অনুসরণীয়। তাই অজাত শত্রু এই মানুষটির যাপিত জীবন যে কোন শিল্পীর জন্যই হতে পারে অনুকরণীয়। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, সঙ্গীত ভুবনের এক মহীরুহের পতন হলো। অনেক বড় শিল্পী হয়েও তিনি ছিলেন নিভৃতচারী ও আত্মমগ্ন। মানুষ কতটা নির্লোভ হতে পারে তার বড় উদাহরণ ছিলেন সুধীন দাশ। মামুনুর রশীদ বলেন, আমাদের দুঃখ হলো সুধীন দাশের মতো নিবেদিত প্রাণ মানুষরা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পান না। রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা সুধীন দাশের কর্মময় জীবনকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। তাই বেদনা নিয়েই বিদায় দিলেন শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চার এই পথিকৃৎ মানুষটি। ইয়াসমীন মুশতারী বলেন, সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে সুধীন দাশ যেন আমাদের মাথার ওপর ছাতা মেলে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে এত আদর ও শাসন দিয়ে কেউ আমাদের গান শেখায়নি। তার শিক্ষাকে আমরা চিরকাল মনের মধ্যে ধারণ করব, চর্চা করব। তার শিক্ষাকে ধারণ করে নজরুলসঙ্গীতের আসল স্বাদ গ্রহণ করে আমরা আগামীর পথে এগিয়ে যাব। নজরুলসঙ্গীত শিল্পী লীনা তাপসী বলেন, আমার দেখা চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিক্ষক সুধীন দাশ। তার আরেক গুণ ছিল, তিনি সকল শ্রেণীর মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন করতেন। তার জীবনের এই অধ্যায়টি সকল শিল্পীর জন্যই শিক্ষণীয়। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সঙ্গীত জীবনে সুধীন দাশ এক কিংবদন্তী হিসেবে চিরকাল উজ্জ্বল থাকবেন। শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ন, সঙ্গীত পরিচালনা, সুরকার হিসেবে তার যে অবদান তা কখনও হারিয়ে যাবে না। আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি এক উদাহরণ হয়ে থাকবেন। নীরবতা পালনের মাধ্যমে শেষ হয় শহীদ মিনারে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। শ্রদ্ধানুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আশির দশকে বাংলাদেশে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয় তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সুধীন দাশ। তিনি রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের গান শিখিয়েছেন। এটা এখন আর দেখা যায় না। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া জানান, ৬ জুলাই বিকেল চারটায় নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে সুধীন দাশের শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে ইনস্টিটিউটের নিজস্ব মিলনায়তনে।
×