ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফোনালাপের তথ্য ফাঁস

পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে মাদক বিক্রেতার গভীর সখ্য

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৪ জুন ২০১৭

পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে মাদক বিক্রেতার গভীর সখ্য

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ চিহ্নিত এক মাদক বিক্রেতার সঙ্গে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) গভীর সখ্যতার ফোনালাপ ও এক পুলিশ অফিসারকে শাসিয়ে মাদক বিক্রেতাকে ফোনে শোনানোর কথোপকথনের ফোন রেকর্ড সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ যেন শর্ষের মধ্যে ভূত। বিষয়টি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা। ঘটনাটি গৌরনদী উপজেলার। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে গত দুই মাসে গৌরনদী মডেল থানা পুলিশ দক্ষিণাঞ্চলের মাদক কারবারিসহ চার শতাধিক বিক্রেতা ও সেবীদের গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে মাত্র দুই মাসেই মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন অসংখ্য মাদকসেবী। ইতোমধ্যে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করেছে অন্যসব মাদক বিক্রেতা। ভাইরাল হয়ে যাওয়া ফোনালাপ ও বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত তিন মাস আগেও জেলার উত্তর জনপদের একমাত্র মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল গৌরনদী উপজেলা। এখানকার প্রতিটি এলাকায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত মরণ নেশা ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। উপজেলার ৬০টি স্পটে এক ধরনের প্রকাশ্যেই বিক্রি হতো এসব মাদকদ্রব্য। এরই মধ্যে গত ২৯ মার্চ রাতে জেলা ডিবি পুলিশের বিশেষ অভিযানে দক্ষিণাঞ্চলের ইয়াবার কারবারি হিরা মাঝিকে তার দুই সহযোগী ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদ ওরফে মনু মোল্লা ও শহিদুল ইসলামকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়। এরপর থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে মাদক কারবারি থেকে শুরু করে বিক্রির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসল পরিচয়। জিজ্ঞাসাবাদে হিরা মাঝি জানায়, দক্ষিণাঞ্চলে মাদকের মূল কারবারি মানিক মাঝিসহ তাদের অন্যসব সহযোগীর নাম। এছাড়াও তারা কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় তৎকালীন গৌরনদী থানার ওসিকে এক লাখ টাকাসহ কতিপয় মিডিয়া কর্মীদের মাসোয়ারা দিয়ে মাদকের কারবার করছে। হিরা মাঝির এ স্বীকারোক্তির পর সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক থানার ওসিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে অন্যদের বিরুদ্ধে অতিগোপনে তদন্ত শুরু করেন। পরবর্তীতে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মাদক নির্মূলের জন্য বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয় ফিরোজ কবির নামের আরেক ওসিকে। গত ২ এপ্রিল শতভাগ মাদকমুক্ত করতে গৌরনদী মডেল থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ ফিরোজ কবির যোগদান করেই মাত্র দুই মাসের মধ্যেই মানিক মাঝি, কালকিনির গিয়াস নলিসহ প্রায় চার শতাধিক মাদক বিক্রেতা ও সেবীদের গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে অন্যতম উপজেলার সুন্দরদী গ্রামের রতন প্যাদার পুত্র রাসেল প্যাদাকে (৩৪) গ্রেফতারের জন্য থানা পুলিশ একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেন। এতেই বাদসাধেন গৌরনদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম। ভাইরাল হয়ে যাওয়া মোবাইল রেকর্ডিং সূত্রে জানা গেছে, তিনি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম) রাসেল প্যাদাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া থানার এক অফিসারকে মোবাইল ফোনে অকথ্য ভাষায় শাসিয়ে মাদক বিক্রেতা রাসেল প্যাদাকে তা শুনিয়েছেন। এছাড়া রাসেলকে গ্রেফতার বা হয়রানি না করার জন্যও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওই এসআইকে নির্দেশ দেন। রাসেলের সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের গভীর সখ্যর ফোনালাপের পুরো বিষয়টি ভয়েস রেকর্ড করে রাখে মাদক সম্রাট রাসেল প্যাদা। পরবর্তীতে মাদক ব্যবসা চাঙ্গা রাখতে রাসেল তার সহযোগীদের কাছে রেকর্ডটি ছড়িয়ে দিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে পুনরায় মাদক ব্যবসা জমজমাট করে তোলে। কয়েকদিনের ব্যবধানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সঙ্গে মাদক সম্রাট রাসেলের গভীর সখ্যতার কথোপকথনের ফোনালাপের রেকর্ডিংটি সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায়। এরই মধ্যে থানা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২০ মে বিকেলে তালিকাভুক্ত রাসেল প্যাদাকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। কথোপকথনের শুরুতে রাসেল প্যাদা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিমকে বলেন, ‘স্যার আমি রাসেল প্যাদা, ওই যে আপনাকে মাছ দিয়েছিলাম। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, কোন মাছ যেন’। এরপর নানা কথোপকথনের একপর্যায়ে রাসেল থানা পুলিশের হয়রানির কথা বলার পর তাকে আশ্বস্ত করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘তুমি আমাকে এসব বিষয়ে আগে বলনি কেন’। একপর্যায়ে রাসেলকে মোবাইলে হোল্ড করে রেখে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থানার এক এসআইকে ফোন দিয়ে শাসিয়ে তা রাসেলকে শুনিয়ে আবার রাসেলকে বলেন, শুনেছ কি বলেছি’। রেকর্ডিং সূত্রে আরও জানা গেছে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের নির্দেশে রাসেল আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরেছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম ২০০৬ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করার পর ২০১৩ সালে সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। ওইসময় জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তার একাধিকবার গোপন বৈঠকেরও অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়েও নিয়মবহির্ভূতভাবে বরিশাল নগরীতে রয়েছে তার জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা। নগরীর সদর গার্লস স্কুলসংলগ্ন এলাকায় জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে তার (রেজাউল করিম) বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের পূর্বের কর্মস্থলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে গভীর সখ্যতা রয়েছে। সে সুবাধেই তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পূর্বে ২০০৬ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন। প্রতিটি অভিযোগের সঠিক তদন্ত করলেই মূল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলেও সূত্রগুলো দাবি করেছেন। রাসেল প্যাদার সাথে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম বলেন, কেউ যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় তাকে সুযোগ দেয়ার বিধান আছে। আমার সঙ্গে যখন রাসেলের কথা হয়েছে তখন আমি প্রশিক্ষণে ছিলাম। জামায়াতের সঙ্গে গভীর সখ্যতা ও ল্যান্ডের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থানার এক পুলিশ অফিসারকে শাসিয়ে রাসেল প্যাদাকে ফোনে শোনানোর বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে রিপোর্টটি প্রকাশ না করার জন্য তিনি বিভিন্ন মহল থেকে অসংখ্য তদবির করিয়েছেন।
×