ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ছাড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৫ মে ২০১৭

প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ছাড়িয়েছে

আনোয়ার রোজেন ॥ দিনে দিনে নতুন উচ্চতা স্পর্শ করছে দেশের অর্থনীতি। স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ‘অর্থনৈতিক মুক্তির’ দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) প্রাথমিক হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাজেটে এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে বাজেটের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। উল্লেখ্য, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর (৭ দশমিক ১১) অতিক্রম করে। এর আগে প্রায় এক দশক দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ ছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৬০২ ডলার হবে। গত অর্থবছর চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে মাথাপিছু আয় বাড়ছে ১৩৭ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের এই হিসাব করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই বড় প্রমাণ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলার। এর আগের দুই অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১৮৪ ডলার এবং ১ হাজার ৫৪ ডলার। অর্থাৎ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। দেশ যে দ্রুত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই লক্ষণ। কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কম, বেশি বা কাছাকাছি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে বেশি হয়েছে মনে হলেও আত্মতুষ্টির কারণ নাই। দেখা যাচ্ছে, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু কৃষি খাতে কমছে। এখন কোন কোন খাত এবং উপখাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং কেন বেড়েছে তা আরও পর্যালোচনার দাবি রাখে। তা না হলে এসব খাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন হবে। জিডিপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এ বিষয়টিকে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখছেন মোস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশে জিডিপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক আগেই ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছে। আমরাও সেদিকে এগুচ্ছে। যদিও প্রত্যাশিত বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ কম। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেসরকারী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। উল্লেখ্য, জিডিপিতে এবার মোট বিনিয়োগের ২৩ দশমিক ০১ শতাংশ বেসরকারী খাতের, বাকি ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ সরকারী বিনিয়োগ। গত অর্থবছরের জিডিপিতে বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৯৯ ভাগ আর সরকারী বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬৬ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস মতে, এবার প্রবৃদ্ধি হবে দশমিক ৮ শতাংশ, যা সরকারের প্রাক্কলন থেকে কম। প্রবৃদ্ধির সরকারী প্রাক্কলন বিষয়ে সরাসরি কোন মন্তব্য করতে না চাইলেও ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি বলতে চাই, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। রফতানি ও রেমিটেন্সে প্রতিকূল হাওয়া বইছে। তবে স্থিতিশীলতা বজায় আছে। প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ানোর জন্য বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানো, শ্রমবাজারের নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং সরকারী ব্যয়ের অপচয়রোধ এবং বিদ্যমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি। বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, গতবারের মতো এবারও সেবা এবং শিল্প খাতের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। যদিও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ। সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এবার কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশের জিডিপির আকার ১৯ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২৪৯ বিলিয়ন ডলার)। গতবছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ১৭ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা বা ২২১ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এক বছরে জিডিপির আকার আর্থিক মূল্যে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এদিকে প্রবৃদ্ধি এবং সার্বিকভাবে মাথাপিছু আয় বাড়ায় দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের ধারাবাহিকতা এবং দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখার কারণে। তাই সকলে মিলে কাজ করে গেলে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। প্রবৃদ্ধি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, পৃথিবার মাত্র দুটি দেশ এবার ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশ এর একটি। অন্যটি ভারত। আমাদের জন্য এটা অসাধারণ সফলতা। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক বরাবরই রক্ষণশীল পদ্ধতিতে প্রবৃদ্ধির হিসাব করে। এ ক্ষেত্রে আমাদের তথ্য-উপাত্তও তারা ব্যবহার করে। আমরা স্বীকৃত রীতিনীতি মেনেই প্রবৃদ্ধির হিসাব করে থাকি। এতে লুকোছাপা বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোন সুযোগ নাই। বরং আমি বলব বিশ্বব্যাংক এবারই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে সর্বোচ্চ প্রাক্কলন করেছে। এবারই প্রথম তারা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে। এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। আগামী বছর আমরা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ঠিক করেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রেমিটেন্স কমে গেছেÑ এ ধারণা সঠিক না। বিবিএসের হিসাব দেখিয়ে মন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালে প্রবাসী আয়ের প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসত। বাকি প্রায় ৩৩ শতাংশ আসত নন-ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। বিকাশ চালু হওয়ার পর ২০১৬ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা হ্রাস পেয়ে ৫১ শতাংশ হয়ে যায়। অন্যদিকে নন-ব্যাংকিং প্রবাহ দাঁড়ায় ৪৯ শতাংশ। এ সময় মোবাইল ব্যাংকিং/বিকাশে আয় প্রবাহের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বিকাশের মতো নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাস আয়ের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলের ওপর নির্ভর করে সামগ্রিকভাবে প্রবাসী আয় কমছে বলা যাবে না। বিকাশের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানো সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, শীঘ্রই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিকাশের সঙ্গে বসবে। বিকাশের ব্যবসা বন্ধ হোক সরকার তা চায় না। বিকাশের মাধ্যমে দেশে আসা অর্থের হিসাব আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখত না। সামনে থেকে এটিও রেমিটেন্সের টোটাল হিসাবে সঙ্গে যুক্ত হবে।
×