ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৎপরতা থেমে নেই

উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের নানা কৌশলে জঙ্গীবাদে টানা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১১ মে ২০১৭

উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের নানা কৌশলে জঙ্গীবাদে টানা হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থামছে না। নানা কৌশলে উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া তরুণদের বাছাই করে জঙ্গী কর্মকা-ের বিভিন্ন স্তরে কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। মূলত সব জঙ্গী সংগঠনের কর্মকা- চলছে একই প্রক্রিয়ায়। জঙ্গী সংগঠনগুলো ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যুবকদের জঙ্গীবাদে টানছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গী কর্মকা-ের বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ইতোমধ্যেই অর্ধ শতাধিক জঙ্গী নিহত এবং কয়েকশ’ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। তার পরেও থেমে নেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গী তৎপরতা। হালে জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা রীতিমত আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে হালনাগাদ চলমান সাঁড়াশি অভিযানে নিহত ও গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগই উচ্চ শিক্ষিত। সর্বশেষ গত ৭ মে সাভারের আশুলিয়া থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত নব্য জেএমবির সদস্য মোঃ ইমরান হোসেন ওরফে ইমরান ওরফে এমরান (৩৪) ও মোঃ রফিকুল ইসলাম ওরফে জুনায়েদ ওরফে রফিকও উচ্চ শিক্ষিত (৪০)। তারা বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। এক সময় তারা কেমিক্যাল নির্ভর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে চাকরি করেছে। একই দিন মতিঝিল থেকে গ্রেফতার হয় আনসার আল ইসলামের নামে তৎপরতা চালানো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সংগঠক আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম শহীদ-উদ-দৌলাহ ওরফে সোহেল (৩২) ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আহাদুল ইসলাম সাগর, জগলুল হক মিঠু ও মোঃ তোয়াসিন রহমান। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ও আনোয়ার আল আওলাকির লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থসহ জঙ্গীবাদের নানা আলামত উদ্ধার হয়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ২০১৪ সালে জঙ্গী হাসান ওরফে রেজার মাধ্যমে তারা জঙ্গীবাদে জড়ায়। ধারণা করা হচ্ছে, হাসান নিঃসন্দেহে উচ্চ শিক্ষিত। গ্রেফতারকৃতরা সিরিয়ায় গিয়ে আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন জামাত-আল-নুসরা ফ্রন্টে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। জিহাদী হিসেবে তৈরি করার উপযুক্ত দেশ হিসেবে তারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়াকে মনে করে। এসব দেশে গিয়ে প্রথমে জঙ্গী ট্রেনিং নেবে। এরপর ফিরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার যোগাযোগ ছিল। তিন ছাত্রকে সিরিয়ায় পাঠানোর সার্বিক দায়িত্ব পালন করছিলেন ওই শিক্ষক। তাকে গ্রেফতার করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু তাকে ওই সময় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন। গ্রেফতারকৃতরা ব্লগার হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হামিদ রহমান খান জানান, ৩ বছর ধরে শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়, বাড়ি ফেরার সময় তিনি নিখোঁজ হন। নিখোঁজের বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ শহীদের বড় ভাই এবিএম শফিক উদ-দৌলা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি জিডি করেন। তিনি জানান, শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পাস করে। তবলীগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে রাজনীতি করত না। সন্দেহজনক কোন কিছুই তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের প্রবর্তন হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে দেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। তিনি ব্রিটেন থেকে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি ২০০২ সাল থেকেই জঙ্গী সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখা গঠনের চেষ্টা করছিলেন। তাকে সহযোগিতা করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশের বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত একটি এনজিওর পলিসি এনালিস্ট শেখ তৌফিক। পরবর্তীতে শেখ তৌফিক রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। শেখ তৌফিক হিযবুত তাহরীরের নীতি গবেষণা কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও সংগঠনটির রাজনৈতিক উপদেষ্টা। তার মাধ্যমেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়। ধনাঢ্য পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে কার্যক্রম চলতে থাকে জঙ্গী সংগঠনটির। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র। তারা মূলত হিযবুত তাহরীরের সদস্য ছিল। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হলে তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে সংগঠিত হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দী মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেহজীব, রেজওয়ান শরীফ, মইনউদ্দিন জিহাদে অংশ নিতে ইয়েমেনে গমন করে। তারা আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সামির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ২০০৯ সালে রেজোয়ান শরিফ ইয়েমেনে গ্রেফতার হয়। রাজীব শরীফ ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হয়। তার ২০ বছরের কারাদ- হয়। আর নাফিস যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। তারা আত্মঘাতী জঙ্গী। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও তেহরিক-ই-তালেবানের অনুসারী। হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংগঠনটির নেতাকর্মীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের সংগঠনের ব্যানারে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটি আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের টার্গেট করেই চলছে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের বিষয়ে মনিটরিং চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এমন তৎপরতা চালিয়ে আসছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থার জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারপরেও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গী তৎপরতা রোধ করা যাচ্ছে না। জঙ্গী সংগঠনগুলো প্রথমেই টার্গেট করছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদের। তাদের দলে ভেড়ানোর পর শিক্ষার্থীদের সংগঠনে ভেড়ানোর কাজ শুরু হয়। এজন্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক ও নেতৃস্থানীয়দের ওপর নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যথায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর যখনই কোন শিক্ষক বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিষয়টি টের পাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের তরফ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দায় চাপিয়ে আদালত বা থানায় অভিযোগ করা হচ্ছে পরিবারের তরফ থেকে। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক কর্মকা-কে রীতিমত ব্যাহত করছে। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলছেন, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি রীতিমত আতঙ্কের। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা। অর্থ ও আদর্শিক বিষয় ছাড়াও দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যদের দলের তরফ থেকে হত্যার করার প্রথা চালু আছে। যা জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার। অন্যথায় উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জঙ্গীবাদের দিকে আকৃষ্ট করা থেকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।
×