ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ॥ বিদ্যুত বাজারে বিপর্যয় আসছে

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৯ মার্চ ২০১৭

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ॥ বিদ্যুত বাজারে বিপর্যয় আসছে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কারণে বিগত দশকে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় বিশ্বে নতুন নবায়নযোগ্য শক্তিÑ সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে এসব খাতে বিনিয়োগ। ২০১৫ সালে সরকারগুলো এসব বিনিয়োগের সমর্থনে ১৫ হাজার কোটি ডলার ঢেলেছে। এদিক দিয়ে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানি। কিন্তু তারপরও কথা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের পরিমাণ এখনও অতি সামান্যÑ মাত্র ৭ শতাংশ। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রাপ্ত বৈশ্বিক এনার্জির পরিমাণ ৮০ শতাংশেরও বেশি। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাসের দিক থেকে দেখলে আমাদের এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার আছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) হিসেবে বৈশ্বিক বিদ্যুত গ্রিডকে কার্বনমুক্ত করতে হলে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত আগামী ২০ বছরে প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে এবং তারপরও সেই প্রক্রিয়া সমাপ্ত হতে অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে। শুভ সংবাদটা হলো এই যে, এক দশক ধরে ভর্তুকি দিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটানোর ফলে এর খরচ কমে এসেছে। অনেক দেশেই নবায়নযোগ্য শক্তি এখনও ব্যয়বহুল হলেও ধীরে ধীরে এর দাম হ্রাস পাচ্ছে। কোন কোন স্থানে বিশেষত বায়ুশক্তি যুক্তিসঙ্গত রকমের প্রতিযোগিতামূলক। এ থেকে বুঝা যায় যে, বায়ুশক্তির প্রসারের জন্য এতদিন যে পরিমাণ ভর্তুকির প্রয়োজন হতো এখন তার চেয়ে অনেক কম ভর্তুকির দরকার হবে। কার্বনের জন্য এখন যে মাশুল দিতে হচ্ছে তার কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি সুবিধাজনক অবস্থায় দাঁড়াবে। নবায়নযোগ্য শক্তিকে বিদ্যুতের বাজারে ঠেলে দেয়ার ফলে তার প্রভাব শুধু দামের ওপর নয় আরও কিছুর ওপর এসে পড়েছে। এটা বিনিয়োগের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। ধনী দেশগুলোতে সরকার নবায়নযোগ্য শক্তিকে বিদ্যুত ব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন সেটার এই নতুন ক্ষমতার কোন দরকার ছিল না। কারণ চাহিদা কমে আসছিল। বাজারের যা চাহিদা তার চেয়ে বেশি সরবরাহের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার ফলে সরবরাহের একটা জোয়ার আসে। তাতে দাম পড়ে যায়। আমেরিকায় কোন গ্যাস বিপ্লবের ফলে ব্যাপারটা কিছুটা চাপা পড়ে গেছে কিন্তু ইউরোপ যে নবায়নযোগ্য শক্তি সয়লাব হয়ে গেছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখানে বিদ্যুতের পাইকারি দর ২০০৮ সালে ছিল প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টা ৮০ ইউরো আজ তা ৩০ থেকে ৫০ ইউরোতে নেমে এসেছে। এর ফলটা পুরনো ধারা ইউটিলিটিগুলোর জন্য বিপর্যকর হয়ে পড়েছে। জার্মানির সবচেয়ে বড় দুই বিদ্যুত কোম্পানি ই.অন ও আরডব্লিউই দুটোই গত বছর ভাগ হয়েছে। এরা তাদের নবায়নযোগ্য শক্তি ও গ্রিড ব্যবসাকে ঋণগ্রস্ত ও লোকসানী প্রচলিত বিদ্যুত উৎপাদন থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ইউরোপজুড়ে ইউটিলিটিগুলো ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিদ্যুতের কম দর থাকার কারণে তাদের ১২ হাজার কোটি ইউরো পরিসম্পদ অপূরণীয় লোকসান হিসেবে গণ্য করে অবলোপন করেছে। এক পর্যবেক্ষক বলেছেন যে, জ্বালানি শিল্পের অভ্যন্তরে মূলধন বিনিয়োগ এ মুহূর্তে যতটা কঠিন ততটা কঠিন সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর কখনই ছিল না। প্রচলিত গ্রিডের বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। তা সেটা তেল হোক, গ্যাস হোক আর কয়লাই হোক। কিন্তু বায়ুবিদ্যুত বা সৌরবিদ্যুতের জন্য কোন জ্বালানি কেনার দরকার হয় না বলেই সেগুলোর প্রান্তিক খরচ কম। এ কারণেই সৌর ও বায়ুবিদ্যুত গ্রিড থেকে অধিকতর ব্যয়বহুল উৎপাদকদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাইকারি দাম কমিয়ে এসেছে। আগামীতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুত শক্তির এত বেশি জেনারেটর স্থাপিত হবে ততই বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। একটা সময় আসবে যখন নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে বিদ্যুতের সমুদয় চাহিদা পূরণ করা যাবে। তখন জীবাশ্ম জ্বালানির দাম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে। ফলে পাইকারি বিদ্যুতের দামে ধস নামবে। এমনকি কখনও কখনও তা নেতিবাচক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন জেনারেটরগুলো বন্ধ করে দেয়ার দরকার হতে পারে। যত বেশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুত কেন্দ্র বসবে তত বেশি এ ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। রোনাল্ডো ফুয়েন্টেস নামে এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুত যদি বাজারের শতকরা একশ ভাগ চাহিদা মেটাতে পারে তাহলে বিদ্যুতের পাইকারি দাম কমতে কমতে শূন্যে নেমে আসবে। তখন এই জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে কেউ আগ্রহী হবে না। সবাই আসলে এই বাস্তবতার দ্বারা আক্রান্ত যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রান্তিক পরিচালন ব্যয় অতি সামান্য বা শূন্য। কারণ প্রকৃতিতে বায়ু ও সূর্যালোক বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যে বাজার ন্যূনতম স্বল্পমেয়াদী খরচে জ্বালানি উৎপাদনের ওপর টিকে আছে সেই বাজার থেকে তেলভিত্তিক বা কয়লাভিত্তিক অধিকতর, ব্যয়বহুল বিদ্যুত কেন্দ্রের মালিকদের প্রতিযোগিতায় হটিয়ে দেয়া হলে বিদ্যুতের দাম পড়ে যাবে এবং তার ফলে সবার আয় কমে আসবে। তবে এর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তিকে দায়ী করলে চলবে না। নীতি-নির্ধারকদের এ ব্যাপারে পরিষ্কার হতে হবে যে, তাদের একটা সমস্যা আছে এবং সেই সমস্যার কারণ নবায়নযোগ্য শক্তি নয় বরং কালের বিচারে সেকেলে হয়ে পড়া বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা। এটা উপলব্ধি করতে পারলে সমস্যা সমাধানও করা যাবে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×