ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লুকানো সৌন্দর্য তুরং ছড়া

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৪ মার্চ ২০১৭

লুকানো সৌন্দর্য তুরং ছড়া

লম্বা ছুটি মানেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ানো-খুুঁজে বেড়ানো নতুন কোন লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এবারের পরিকল্পনা ছিল প্রকৃতি কন্যা সিলেট বিভাগ চষে বেড়ানো। ছুটি শুরুর আগের রাতেই মাইক্রোতে চড়ে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের নয় ভ্রমণ পাগলা ছুটি। বৃষ্টিভেজা গভীর রাতে সুনসান নিরিবিলি রাজপথে গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। ঢাকা ছাড়ার পর বাতিহীন অন্ধকার পথের শুরু। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকারেরও আলো আছে। সেই আলোর অনুভূতি ভিন্ন শিহরণের। এক অন্য রকম অনুভূতি সঙ্গী করে সারারাত নানা গল্পসল্প, আলাপ-আলোচনা করতে করতে সকাল ৯টার মধ্যেই সিলেটের বাদাঘাট পৌঁছাই। আগে থেকেই আমাদের জন্য নোঙ্গর করা ছিল বিশাল এক বালুর কার্গো। ৯ জনের জন্য কমপক্ষে তিন শ’ জন ধারণ ক্ষমতার কার্গো। এ যেন মশা মারতে কামানের গোলা। কি আর করা হেসে-খেলে- গেয়ে-নেচে উল্লাস করি। বাদাঘাট হতে কার্গো ছেড়ে যখন ডাকাতি হাওড়ে পড়ে তখন প্রকৃতির কি যে আনিন্দ রূপ তা বোঝানো যাবে না। একটা জায়গায় তো মনেই হবে আপনি সিলেট নয় সুন্দরবনের কোন সরু খাল দিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় ওয়াও! হাওড় শেষে ধলাই নদী। সে আরেক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছড়া কবিতা। সব যদি ঘরে বসেই জেনে যান তাহলে ঘুরতে গিয়ে দেখবেন কি? তাই আপনার অনুভূতি জানার জন্য আজ ধলাই নিয়ে না লিখি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর কোম্পানীগঞ্জের দয়ার বাজার পৌঁছি। সিলেট ট্যুরিস্ট ক্লাবের সদস্য সজ্জন ব্যক্তি জামান ভাই খেয়াঘাটে এসে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুদের রিসিভ করেন। তিনি আমাদের জায়গা দিলেন তার বাড়িতে। তার সেবা-যতেœর ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। জুমার নামাজ পড়ে খেয়েদেয়ে বিকেলটা কাটাই মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ- ভোলাগঞ্জের জিরো পয়েন্টের সাদা পাথরের রাজ্যে। সঙ্গী-সাথীরা উজান থেকে নেমে আসা হিমশীতল পাথুরে ধলাই নদীতে জলকেলিতে মেতে ওঠে। আমি না ভিজে এদিক সেদিক হাঁটি। গত তিন বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন খুঁজে পাইনি একটিও চিপসের প্যাকেট অথচ এবার যেমন বেড়েছে পর্যটক তার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চিপসের প্যাকেট আর প্ল্যাস্টিকের খালি বোতল। সে এক বিদ্ঘুটে অবস্থা। অবশেষে স্থানীয় সামাজসেবক কালাম ভাই ও অন্যদের সহযোগিতায় কিছুটা পরিষ্কার করি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মাগরিবের নামাজ শেষে দয়ার বাজারের উদ্দেশে পানি পথ ধরি। দয়ার বাজার এসে চাল-ডালÑমুরগি- তেল-মসলা কিনে আশ্রয় পাওয়া বাড়ির বিশাল উঠানেই চলে বারবিকিউর প্রস্তুতি। সঙ্গে লেটকা খিচুড়ি। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য, আমরা সবাই তখন ছিলাম জগতসেরা বাবুর্চি। খেয়েদেয়ে যাই এবার ঘুমোতে। ঘুম কি আর আসে বাউন্ডেলে পোলাপানের রসালো আলাপের কারণে। তবুও চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা। পরদিন সকালে ছুটি হালের ক্রেজ হতে যাওয়া উৎমা ছড়ার পথে। কিছুটা পথ চলার পরেই চোখ আটকাবে অধরা পাহাড়ের সবুজ গালিচায় মোড়ানো ক্যানভাসে। আরও কিছুটা পথ এগুলে -পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম ধারায় নেমে আসা ঝর্ণার অট্টহাসি সঙ্গী করে পৌঁছে যাবেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের উৎমা ছড়ার বাহুতে। মোটরবাইক থেকে নেমেই হই আশ্চর্য! একি মানুষ যতদূর খোঁজ পেয়েছেÑ তার চেয়েও ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এর পর নেমে যাই এক্কেবারে মেঘালয়ের সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ী ছড়ায়। মেতে উঠি আনন্দে। অনেকটা সময় কাটিয়ে যাই এবার তুরং ছড়ার পানে। ভোলাগঞ্জের ফারুক ভাই জায়গাটার খোঁজ দিয়েছেন। হাফিজ ভাইয়ের বাইকে চড়ে ছুটি। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন মুগ্ধতা ভর করে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি। নৈঃশব্দের মায়াবী পথের দৃশ্য- আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে থাকা দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়, সেই পাহাড়ে ঘুমিয়ে থাকা শুভ্র মেঘের ভেলা- নীল আসমানের আলোকরশ্মি- বাঁশবাগানের ছায়া, বিস্তৃত ফসলের মাঠÑ সব মিলিয়ে যেন স্বাদের কাঁচাগোল্লা খাওয়ার মতো মনে সুখ সুখ ভাব। বাইক ছেড়ে এবার গ্রামের মেঠো পথ ধরে সামান্য কিছু পথ মাড়িয়ে হাজির হই প্রকৃতি কন্যা তুড়ং ছড়ার জমিনে। চার পাশ সুনসান নিরিবিলি। নিঝুম নিস্তব্ধতার তুড়ং ছড়ার একমাত্র সঙ্গী পাথরের গা ভিজিয়ে অবিরাম ধারায় ধেয়ে আসা স্বচ্ছ পানির কলকল শব্দ। এমন নয়ন জুড়ানো প্রকৃতির কাছে হার মেনে আবারও নিজেদের সমর্পণ করি হিমহিম স্ফটিক শীতল স্বচ্ছ পানিতে। তুড়ং ছড়াকে অনেকে কুলি ছড়া নামেও ডেকে থাকে। এখানে এখনও নির্মল প্রকৃতি বিনষ্টকারী হায়েনাদের লোলুপদৃষ্টি পড়েনি, মাড়ায়নি কোন গাইরা (নোংড়া) পর্যটকের দল। দু-চারজন বাসিন্দা যাও দেখলামÑ তারাও যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শান্ত কোমল। এ রকম দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয় নৈসর্গিক পরিবেশের সাক্ষাত পেয়ে বেশ উৎফুল্ল অনুভব করি। অপার সৌন্দর্যের তুরং ছড়ার ধবধবে সাদা পানি, সবুজ বৃক্ষ, লালচেÑ বাদামি রঙা পাথর সব মিলিয়ে এক অন্য জগত। পানির স্বচ্ছতা এতটাই যে, হাঁটু সমান পানির নিচের পাথরগুলোও স্পষ্ট দেখা যায়। আরও দেখা যাবে উজান থেকে ভাটিতে পানি নামার অভূতপূর্ব দৃশ্য। তুরং ছড়ার ভৌগোলিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবগাহন কয়েক পাতা লিখেও শেষ হওয়ার নয়। যা শুধু স্বচক্ষে দেখে অনুভব করা সম্ভব। আমাদের কেউ একজন ছড়া ধরে হেঁটে ভুল করেই সীমানা পেরিয়ে ভারতের চেরাপুঞ্জি ঢুকে গিয়েছিল। যখন সে আমাদের শোরগোলে জানল- তখন তাহার অবস্থা, ছেড়ে দে মা কাইন্দা বাঁচি। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচি। বন্ধু ফিরে এসে, এগিয়ে যাওয়া ওইটুকু জায়গা সম্পর্কে যখন বর্ণনা দিলÑ তখন আমরা আফসোসে মরি। এবার বিদায়ের পালা- তা হলে বন্ধুরা আর দেরি কেন? দুই দিন সময় হাতে নিয়ে ঘুরে আসুন পানি- পাথর আর মায়াবিনী প্রকৃতির রাজ্য থেকে। কিভাবে যাবেন : ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ হতে সিলেটে যাবার বিভিন্ন পরিবহনের দিনে রাতে বাস সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া চার শ’ পঞ্চাশ হতে বারো শ’ টাকা মাত্র। এ ছাড়া ট্রেন ও আকাশপথেও যাবার সুযোগ রয়েছে। ট্রেনে তিন শ’ ষাট টাকা হতে বারো শ’ টাকা পর্যন্ত। বিমানে তিন হাজার হতে পঁয়ত্রিশ টাকা মাত্র। সিলেট শহরের আম্বরখানা হতে সিএনজিতে কোম্পানীগঞ্জ দয়ার বাজার। ভাড়া জনপ্রতি দু’শ’ হতে দু’শ’ পঞ্চাশ টাকা। এ ছাড়া বর্ষায় সিলেটের বাদাঘাট হতে নৌপথে দয়ারবাজার। ভাড়া জনপ্রতি দু’শ’ বিশ টাকা। সেখান থেকে আবারও সিএনজিতে চড়ে জনপ্রতি চল্লিশ টাকার বিনিময়ে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরবর্তী চড়ার বাজার যেতে হবে। বাজার হতে দশ মিনিট হাঁটলেই মিলে যাবে উৎমা ছড়ার সৌন্দর্য। আর তুরং ছড়া যাবার জন্য কোন বাহন নেই, দু’-পা হবেই তখন সম্বল তবে দূরত্ব উৎমা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার। যারা ঢাকা বা অন্য কোন জেলা হতে মাইক্রো বা নিজস্ব বাহন নিয়ে যাবেন তারা অবশ্যই গাড়ি সিলেট শহরে রেখে সিএনজি/ট্রলারে কোম্পানীগঞ্জ যাবেন কারণ রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। থাকবেন কোথায়, খাবেন কী : ঢাকা থেকে আগের দিন রাতে রওনা দিয়ে পরের দিন সারা দিন ঘুরে আবারও ফিরে আসতে হবে সিলেট শহরে। দয়ার বাজারে খাবারের হোটেল পাবেন আর চড়ার বাজার থেকে খেয়ে নেবেন পোলাওর সঙ্গে ছোলা-বুট। এখানকার জন্য বলা যায় এটা স্পেশাল খাবার। রাতে থাকার জন্য সিলেট শহরে মিলবে নিম্ন হতে একেবারে উচ্চ মানের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। আরও বেশি তথ্য জানতে ঢুঁ মারুন গুগল সার্চে। আমি শুধু ধারণা দিলাম মাত্র।
×