ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টঙ্গীতে শিক্ষকের প্রহারে অন্ধ হতে চলেছে কলেজছাত্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২০ মার্চ ২০১৭

টঙ্গীতে শিক্ষকের প্রহারে অন্ধ হতে চলেছে কলেজছাত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা, টঙ্গী, ১৯ মার্চ ॥ উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রকে টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড কলেজ শিক্ষকের বেত্রাঘাতে একটি চোখ অন্ধ হতে চলেছে। ওই কলেজ ছাত্রের নাম মিরাজ হোসেন শাওন। বর্তমানে সে চোখের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তাররা বলছে, সে আর ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি ফিরে নাও পেতে পারে। নির্দয় ওই শিক্ষকের পক্ষে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতবৃন্দ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষসহ সকল মহল সাফাই গাইছে। টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড কলেজের ভেতরের রাস্তা দিয়ে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার অপরাধে শাওনের উপর এ নির্মম অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। টঙ্গী স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিযুক্ত শিক্ষক বলছেন, শাওন স্কুল চলাকালে দারোয়ানদের বাধা উপেক্ষা করে স্কুলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ করতে চায়। শিক্ষকরা বলছে ওই ছাত্র নাকি গণপিটুনির শিকার হয়ে রক্তাক্ত জখম হয়। উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজের ড্রেস পরা অবস্থায় কলেজে যাওয়ার পথে গত বুধবার সকাল টঙ্গী স্কুল এ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে মারধরের এ ঘটনাটি ঘটে। আহত ছাত্রের মা বিলকিস সুলতানা জানান, মিরাজ হোসেন শাওন টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড গার্লস কলেজ থেকে গত বছর এসএসসি পাস করার পর উত্তরা হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয়। গত বুধবার সকালে শাওন তাদের টঙ্গী কলেজ রোডের বাড়ি থেকে উত্তরায় কলেজে যাচ্ছিল। পথে তার বন্ধুর কাছ থেকে নোটশিট নেয়ার জন্য পাইলট স্কুল অতিক্রম করে হাসান সরকার রোডে যাচ্ছিল। সে পাইলট স্কুলের গেট দিয়ে ভেতরের রাস্তায় প্রবেশ করতেই পেছন দিক থেকে স্কুলের দারোয়ানরা তাকে টেনে ধরে এবং স্কুলের রাস্তা দিয়ে যেতে নিষেধ করে। এ সময় শাওন দারোয়ানদের অনুরোধ জানিয়ে বলে, ‘কলেজের সময় হয়েছে ঘুরে গেলে সময় নষ্ট হবে, দয়া করে আমাকে যেতে দিন’। এ সময় পাইলট স্কুলের শিক্ষক শাহাবুদ্দিন সজিব ছাত্র শাওনকে কিলঘুষি ও লাথি মারে। পরে তাকে টেনে হেঁচরে স্কুল ক্যাম্পাসের ভেতরে অধ্যক্ষের অফিসের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে শিক্ষক সজিব অধ্যক্ষের সামনেই তাকে মোটা বেত দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। বেত্রাঘাতে শাওনের ডান চোখ দিয়ে প্রচ- রক্তক্ষরণ শুরু হয়। হাউমাউ করে কান্না কাটি করতে থাকে শাওন। উপস্থিত শিক্ষকদের ভয়ে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। এক পর্যায়ে শাওনকে গলা ধাক্কা দিয়ে স্কুল গেট দিয়ে বাহিরে বের করে দেয়া হয়। এ সময় পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় সিটি চক্ষু হাসপাতালে নেয়। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে তাকে দ্রুত ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন এই সংবাদ উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজে পৌঁছলে শাওনের সহপাঠীরা বৃহস্পতিবার টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড গার্লস কলেজে এসে শিক্ষক শাহাবুদ্দিন সজীবের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে। খবর পেয়ে পুলিশ স্কুলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও অভিভাবকদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এদিকে শাওনের মা বিলকিস সুলতানা বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত শিক্ষক সজিবের বিরুদ্ধে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু পুলিশ গত তিনদিনেও অভিযোগ এফআইআর ভুক্ত করেনি। এদিকে যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত শিক্ষক শাহাবুদ্দিন সজীব বলেন, আমি শাওনকে প্রহার করিনি। মারধরের কোন ঘটনা ঘটেনি। যৌন হয়রানির অভিযোগে ছাত্রীদের অভিভাবকরা তার ওপর চড়াও হলে আমি তাকে উদ্ধার করে প্রিন্সিপালের কক্ষে নিয়ে যাই। টঙ্গী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, উভয়পক্ষ থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়েছে। আহত ছাত্র শাওনের মা বিলকিস সুলতানা স্কুলের আলোচিত শিক্ষক সজীব ও দারোয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। অপরদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ আহত ছাত্র শাওনের বিরুদ্ধে ছাত্রী উত্ত্যক্তের অভিযোগ দিয়েছেন। উভয় অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। শনিবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর আউচপাড়ায় শাওনদের বাসায় শাওনের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে তার পরিবারের সবায় কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এ সময় শাওনের বাবা মোতালেব হোসেন ঘটনার বিচার ও শাওনের সুচিকিৎসার দাবি জানান। শাওনের বোন মুনমুন তার ভাইয়ের এ অবস্থার জন্য টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও দারোয়ানদের দায়ী করেন। শাওনের চিকিৎসক রাজধানীর বসুন্ধরা আই হসপিটাল এ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক প্রফেসর ডাঃ মোঃ সালেহ আহমেদ জানান, শাওনের ডান চোখের দুই তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে গেছে। তার ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ। ডান চোখের রেটিনায় প্রচ- রক্তক্ষরণ ঘটেছে। পূর্ণাঙ্গ অপারেশন শেষে শাওন ডান চোখের জ্যোতি ফিরে পাবে কিনা নিশ্চিত করে বলা যাবে। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন, বেত্রাঘাতে শাওনের চোখের লেন্স নষ্ট হয়ে গেছে। মাথা ও চোখে মারধরের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণে চোখের রেটিনা এবং কর্নিয়া ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে টঙ্গী পাইলট স্কুল এ্যান্ড গার্লস কলেজ অধ্যক্ষ মোঃ আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ছাত্রীদের ছুটি হওয়ার সময় শাওন ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে স্কুলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তখন দারোয়ান বাধা দিলে সে দারোয়ানদের সঙ্গে উচ্চবাচ্য শুরু করে এবং একপর্যায়ে মারতে যায়। পরে ছাত্ররা তাকে ধরে নিয়ে বেদম মারধর করে। এলাকাবাসী বলছেন, উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজের ড্রেস পরা অবস্থায় একজন ছাত্রকে ক্যাম্পাসে নিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করে রক্তাক্ত করা হয়েছে তা উপস্থিত সকলকে কাঁদিয়েছে কিন্তু কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি স্কুলের দারোয়ান ও শিক্ষকদের ভয়ে।
×