ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর ইমেজ সঙ্কট কাটল

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৫ মার্চ ২০১৭

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর ইমেজ সঙ্কট কাটল

শংকর কুমার দে ॥ এই প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী ১৫ দেশের পুলিশ প্রধান ও ইন্টারপোলসহ কয়েকটি সংস্থার অংশগ্রহণে সম্মেলনের যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে মিলন মেলা ভেঙ্গে গেল মঙ্গলবার। ‘জঙ্গীবাদ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ’ দমনে সহযোগিতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ আর অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর পুলিশ প্রধানদের তিন দিনের সম্মেলন। এখন হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে, তিন দিনব্যাপী সম্মেলন থেকে কি পেলাম? গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর বিদেশে দেশের যে ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছিল তা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা পালন করেছে সদ্যসমাপ্ত এই সম্মেলন। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে সম্মেলনে উপস্থিত অতিথিদের বক্তৃতায়। রবিবার সকাল ১০টায় তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। উদ্বোধনী বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দেশের জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন না, আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ দমনে ভূমিকা রাখছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তৃতায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালানো জঙ্গীবিরোধী অভিযানে পুলিশের বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা করায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইন্টারপোলের মহাসচিব জারগান স্টোককে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলনের উদ্বোধনীতে ইন্টারপোলের মহাসচিব জারগান স্টোক তার বক্তৃতায় বাংলাদেশ গত বছর হলি আর্র্টিজানের মতো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- ও মোকাবেলা করায় জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনের সক্ষমতার জন্য বাংলাদেশের প্রসংশা করেন। সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক বলেন, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ আঞ্চলিক বা কোন একটি দেশের একক সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে সম্মেলনের প্রথম দিন রবিবার সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স এ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের পরিচালক রোহান গুণারতেœ বলেছিলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করেছিল আইএস, জেএমবি নয় বলে যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন তারও একটি সন্তোষজনক সমাধান হয়েছে আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তৃতায়। দেশী-বিদেশী অন্তত অর্ধশতাধিক প্রতিনিধিদের কারও বক্তৃতায়, আলোচনায় বাংলাদেশে আইএস আছে এমন কথা না বলায় রোহান গুণারতেœ ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। তবে সম্মেলনের দ্বিতীয় ও সমাপনী দিনে রোহান গুণারতেœর দেয়া মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য খ-ন করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে, যাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিদেশী অতিথিরা তাদের বক্তৃতায়ও। পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সোমবার সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সারাদিন যে আলোচনা হয়েছে তাতে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে বিদেশে পলাতক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ইন্টারপোলের সহায়তার অঙ্গীকার আদায়ের বিষয়টি। এ ছাড়াও জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক বিশেষ করে ইয়াবা পাচার বন্ধ ও মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানা বন্ধের জন্য মিয়ানমারের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা হয়। এ ছাড়াও লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান সর্বোচ্চ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি হওয়া সত্ত্বেও ইন্টারপোল কর্তৃক তার রেড ওয়ারেন্ট প্রত্যাহারের বিষয়টি। এ ছাড়াও ফেসবুক প্রতিনিধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই প্রতিনিধির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অপরাধ দমনে আলোচনার অগ্রগতির প্রসঙ্গে। পুলিশ প্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মঙ্গলবার সমাপনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশের জঙ্গীদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেট বা আন্তর্জাতিক অন্য কোন জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে আমরা বিশ্বে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান প্রত্যক্ষ করা গেলেও বাংলাদেশের জঙ্গীরা হোম গ্রোন। বিদেশী কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বিস্তারের একটা চেষ্টা থাকতে পারে। সে জন্য বাংলাদেশ মনে করে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা থাকা দরকার। বাংলাদেশ সরকার জঙ্গীবাদ দমনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কার্যকর সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে ১৫ দেশের পুলিশ প্রধান ও ইন্টারপোলসহ কয়েকটি সংস্থার অংশগ্রহণে জঙ্গীবাদ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে সহযোগিতা বাড়াতে নানা উদ্যোগের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর পুলিশ প্রধানদের তিন দিনের সম্মেলন। আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে কৌশল উদ্ভাবন, ইন্টারপোল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে ওয়ান-টু-ওয়ান কমিউনিকেশন ও পুলিশ প্রধানদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে একটি প্ল্যাটফরম গঠন, কাউন্টার টেররিজমের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তথ্য বিনিময়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা, দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাগত সম্পর্ক জোরদার, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে নেটওয়ার্ক স্থাপন, মানি লন্ডারিং ও সাইবার ক্রাইম নিয়েও আলোচনা হয়েছে তিন দিনব্যাপী পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে। আয়োজক, উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ, অতিথিবৃন্দের সঙ্গে তিন দিনব্যাপী পুলিশ প্রধানদের সম্মেলন থেকে কি পাওয়া গেল জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে একটি বার্তা পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হলো। এ ছাড়াও এই প্রথমবারের মতো ১৫ দেশের পুলিশ প্রধানদের একটি সম্মেলন সফল করার মতো ঘটনায় বাংলাদেশ গৌরবান্বিত হয়েছে বলে সবারই অভিন্ন মতামত। সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মনে করেন, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। প্রথমত হলি আর্টিজানের পর দেশে-বিদেশে কিছুটা নিরাপত্তা ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। এই সম্মেলনে এত দেশের প্রতিনিধিরা বক্তব্যে ও মতামতে জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিদেশী অতিথিরা নিজেরাও বাংলাদেশে এসে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করে গেছেন, যা আমাদের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক ও সুখকর।
×