ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে

সিএনএনের অনলাইন নিউজে সম্প্রতি একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ২০-২২ বছরের একটি রোহিঙ্গা মেয়ে অঝোর ধারায় কান্না করছে এবং হাত দিয়ে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে। পাশে আরেকটি ছবি। এ ছবিতে একটি আহত শিয়ালকে ঘিরে আছে দুটি বন্য সিংহ। এই ছবিটির নিচে ক্যাপশনে লেখা- এই সিংহরা আহত শিয়াল পেলে কেউ জানে না তারপর কি হতে যাচ্ছে। এই ছবি দেখে হৃদয়বান সব মানুষেরই অস্থির হয়ে ওঠার কথা। এখানেই মানুষ আর মনুষ্যত্বের পরিচয় মেলে। এই ছবিটি দেখে হঠাৎ করে আমার আরেকটি ছবির কথা মনে পড়ে যায়। ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে একদল দুর্বৃত্ত অমানুষ যশোরের মালোপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট করে এবং নারী-শিশুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। তখন দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিকে একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, মধ্যবয়সী একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী তার দেড়-দুই বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া নিজ ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলার চোখ থেকে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছে, আর শিশুটি চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। নিচে লেখা- গত ২৪ ঘণ্টায় শিশুটি কোন খাবার পায়নি। সভ্য ও আধুনিক জগতে বাস করছি বলে আমরা দাবি করি। সিরিয়ার সেই শিশু আয়লান কুর্দির সাগর পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছবি আমাদের মতো অক্ষম ক্ষমতাহীন মানুষকে কাঁদায়। কিন্তু বিশ্বের ক্ষমতাশালী মানুষের পাষাণ হৃদয় নড়ে না। সব অসহায় মানুষের ওপরই যেন তাদের যত ক্ষোভ। সেদিন আরেকটি স্টিল ছবি দেখলাম হিন্দুস্তান টাইমসের অনলাইন সংস্করণে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসন ও পাঁচটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পরের ঘটনা। ছবিতে দেখা যায়, সোমালিয়ার একজন তরুণ নারী তার দেড়-দুই বছরের ছেলেকে কোলে করে আমেরিকা থেকে পালিয়ে কানাডায় প্রবেশের চেষ্টা করছেন। সীমান্ত পুলিশ তাকে ধরে ফেলে এবং টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে ওঠানোর চেষ্টা করছেন, আর অন্যদিকে কোলের শিশুটি ভয়ে চিৎকার করে কান্না করছে। ফিরে আসি মিয়ানমার সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার কথায়। মাত্র ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ, যারা জাতিতে রোহিঙ্গা এবং ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তাদের চিরতরে উৎখাত এবং নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার কয়েক দশক ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই চেষ্টায় তারা ইতোমধ্যে অনেকখানি সফলও হয়েছে। মিয়ানমারের চেষ্টার ধারা অব্যাহত থাকলে আর কয়েক বছরের মধ্যে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে, তারা পরিপূর্ণভাবে সফল হবে। আর পরাজিত হবে বিশ্ব মানবতা। মানবতার ঝা-া বহনকারী পশ্চিমা বিশ্ব প্রায় চার দশক নীরবতা পালন করার পর ইদানীং উচ্চবাচ্য করা শুরু করলেও ঝেড়ে কাশছে না। কেমন যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’, এরকম একটা ভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীন তদন্ত করার কথা বলেছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকজন রাষ্ট্রদূত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে ওই একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ এবং তদন্ত দাবি করছেন। কোন কোন রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এতে মিয়ানমার সরকার কিছুটা নড়াচড়া শুরু করেছে। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার একটা তদন্ত বা পরিস্থিতি মূল্যায়নে কমিটি গঠন করেছে, যার প্রধান করা হয়েছে মিইন্টসিউ নামক একজন জেনারেলকে, যিনি এর পূর্বে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নেতৃত্বে দেন। সে সময়ের অপকর্মের জন্য আমেরিকা তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। তাছাড়া ওই কমিটিতে রোহিঙ্গাদের কোন প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। সুতরাং এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন কেমন হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনের লেগেসি অনেক লম্বা. তবে ১৯৭৮ সালে রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার সক্রিয়ভাবে জাতিগত উৎখাত ও নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। রোহিঙ্গা উৎখাত ও নিশ্চিহ্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার তখন প্রিয়্যামটিভ এ্যাকশনে যায়। কোনরকম বিদ্রোহ বা উস্কানি ব্যতীত নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ এমন সামরিক অভিযান বিশ্বে একমাত্র হিটলার ছাড়া আর কেউ করেনি। ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার একই রকম সামরিক অভিযান চালায়। তার আগে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়। যদিও বাকি ১৩৫টি জাতিগত নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সকলেই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পায়। এই যে একটার পর একটা ঘটনা ঘটেছে তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মিডিয়া, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো নীরব ভূমিকা পালন করেছে। তারা সোচ্চার হতে শুরু করেছে ২০১২ সালে আরেক দফা নিধনযজ্ঞের পর। তখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন নারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগে আবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী অভিযানে নামে। সে সময়ের ঘটনার ওপর ব্যাঙ্ককভিত্তিক মানবাধিকারকর্মী এবং অধিকার সংরক্ষণ নামক সংগঠনের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ সিমথ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন। সেগুলো সিএনএন এবং টাইমস ম্যাগাজিনে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। একটি রিপোর্টের সামান্য অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর। ঘটনাস্থল ছোট গ্রাম ম্যাউকইউ। সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মী সম্প্রদায়ের লোক একসঙ্গে ওই গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ৭০ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে বন্দুকের নলের সামনে এক জায়গায় তারা জড়ো করে এবং ব্রাশফায়ার করে সবাইকে হত্যা করে। তারপর একসঙ্গে গণকবর দেয়া হয়। ৭০ জনের মধ্যে ২৮ জন ছিল শিশু, যার ভেতরে আবার ১৩ জন পাঁচ বছরের নিচের বয়সের। কয়েকজন শিশুকে আগুনের ভেতর নিক্ষেপ করার কথা উল্লেখ করেছেন ম্যাথিউ তার প্রতিবেদনে। এটাকে প্রতিবেদক বলেছেন সেনাবাহিনী ও বর্মী সন্ত্রাসীদের ঠা-া মাথায় গণহত্যা। ওই সময়ে আলজাজিরা টেলিভিশন গোপনে ধারণকৃত কয়েকটি প্রতিবেদন প্রচার করে। তাতে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনাসহ সবচাইতে ভীতিকর ও আশঙ্কাজনক যে দৃশ্যটি ছিল তা হলো, প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিজ নিজ বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে ৪০টি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে চারপাশে সেনাবাহিনী ও বর্মী সম্প্রদায়ের দ্বারা পাহারা বসিয়ে দেয়ার দৃশ্য। মুরগির খাঁচা পাহারার জন্য শিয়াল নিয়োগ করার মতো ঘটনা। কোন ক্যাম্পেই সামান্য মানবীয় প্রয়োজন মিটাবার মতো ব্যবস্থা নেই। এটাকেও পরিকল্পিত মনে হয়। এভাবে থাকলে ধীরে ধীরে প্রথমে শিশু এবং তারপর অন্যরা এমনিতেই মৃত্যুবরণ করবে, কারও কিছু করা লাগবে না। এটাকে মানবাধিকারকর্মীরা হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এগুলো চার দশক ধরে চলে আসা নির্যাতনের সামান্য কিছু প্রতীকী বর্ণনা। তবে দেরি হলেও সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে এসে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বের্গে ব্রেন্দি বলেছেন, রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও চাপ সৃষ্টি করা উচিত। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন গত সপ্তাহে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিছুদিন আগে ইয়াংহি একটা বক্তব্যে বলেছেন, সম্প্রতি সেনাবাহিনীর হাতে প্রায় ৪০০ জন নিহত এবং ৬৫ হাজার মানুষ উৎখাত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখ থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী শুনে গেছেন। সবচাইতে প্রণিধানযোগ্য ও সময়োচিত আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রেজাক। তিনি বলেছেন, আমরা চোখ-মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না। তাদের রক্ষা করতে হবে এ জন্য যে, তারাও মানুষ। তিনি জাতিসংঘকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, বিশ্ব সমাজ বসে বসে গণহত্যা দেখতে পারে না। জানুয়ারি মাসে কুয়ালালামপুরে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে ১০ দফা ইশতেহার প্রকাশসহ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই সংগঠনটি কার্যকর হলে বিশ্বের পথে প্রান্তে মুসলমানদের এত নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হতো না। ৫৭টি দেশের সংগঠন ওআইসি সৃষ্টির পর থেকে ঠুঁটো জগন্নাথ এবং মাকাল ফলের পরিচয় দিয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্ব আজ ছিন্ন-ভিন্ন, লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া। প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করছে। এসব দেখেশুনে ওআইসি সটান হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বন্ধ এবং সব অন্ধত্বের পথ ত্যাগ করে মুসলিম শাসকগণ যদি পশ্চিমা বিশ্বের লেজুরবৃত্তি ছাড়তে পারে তাহলে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক যেভাবে মসুলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে তার কোন প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্বের নেতাদের মুখে শোনা যায় না। ওআইসি তো ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে। যে কথা একটু আগেই বলেছি। কুয়ালালামপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককে ফলপ্রসূ করতে হলে ওআইসির পক্ষ থকে জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী বৈঠক ডাকতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের মহাসচিবকে আহ্বান জানাতে হবে যাতে তিনি জরুরীভিত্তিতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে আসেন। একই সঙ্গে স্থায়ী সমাধানের পথে সন্ধান ও সুপারিশের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ কমিশন গঠন এবং মিয়ানমার সরকারের ওপর অব্যাহত চাপ বজায় রাখতে হবে। দূর থেকে শুধু বক্তৃতা, বিবৃতি আর মিডিয়ার চেঁচামেচিতে মিয়ানমার কান দেবে বলে মনে হয় না। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ
×