ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের ফুল ফুটিয়ে পার হলো ভালবাসা দিবস

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জীবনের ফুল ফুটিয়ে পার হলো ভালবাসা দিবস

মনোয়ার হোসেন ॥ বসন্ত দিনের উতলা বাতাসমাখা ভরদুপুরে একে অপরের হাতটি ধরে হাঁটছিলেন দু’জনে। রমনার সবুজ ঘাসে হেঁটে চলছিল তাদের ভাব বিনিময়। কিছুক্ষণ পরপর পরস্পরের মধ্যে হচ্ছিল চোখাচোখি। সে চোখের ভাষায় ছিল ভালবাসার প্রগাঢ় আহ্বান। মুখে ছিল প্রণয়ের সংলাপ। ধীর পায়ে পেছন থেকে সামনে গিয়ে মুখোমুখি হই এই প্রেমিক-প্রেমিকার। পরিচয়টি পেশ করে জানতে চাই তাদের প্রেমের কথা। সদ্যবন্ধনে জড়ানো যুগলটি পুরো নাম না বলে জানিয়ে দিল ডাকনামটি। শিমুল ও সম্প্রীতি নামের প্রেমিকযুগল বলে ওঠে, এই তো কিছুদিন আগে বন্ধুদের এক আড্ডায় আমাদের পরিচয়। সেদিন শুধু জেনে নিয়েছিলাম পরস্পরের নামটি। এরপর কথা হয়েছে মুঠোফোনে। সেখান থেকেই ভাললাগা, অতঃপর ভালবাসা। আজ প্রেম প্রকাশের বিশেষ দিনে তাই ঘুরছি দু’জন দুজনের হাতে হাত রেখে বলে ফেললাম ফোনে বলতে না পারা জমে থাকা মনের সবটুকু কথা। এখন দু’জন মিলে প্রেমের মাঝে জীবনের পূর্ণতা খোঁজার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যত জীবনসঙ্গীর ভাললাগা ও মন্দলাগার বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করছি। ঘটছে আমাদের দুটি হৃদয়ের সবটুকু প্রকাশ। সবকিছু মিলে মনে হচ্ছেÑ প্রেম একটি শিল্প, একটি দর্শন এবং বেঁচে থাকার প্রধান আকর্ষণ। এই প্রেমিকযুগলের কথামতোই ভালবাসা ছাড়া পূর্ণতা পায় না মানবজীবন। অপরিপূর্ণ সেই জীবনটা হয়ে ওঠে বিবর্ণ। তাই তো ভালবাসার প্রাপ্তি বা পরিচর্যায় জীবন হয় সুন্দর ও স্বার্থক। সৃষ্টির অনাবিল আনন্দে সমান্তরাল পথে এগিয়ে চলে জীবন ও ভালবাসা। পারস্পরিক মমতার বন্ধনে হয়ে ওঠে একে-অপরের আশ্রয়। সেই বন্ধন অটুট রাখার প্রচেষ্টায় নীরার বাগান কবিতায় কবি বলে যায়Ñ যতো না এঁটেল মাটি তার চেয়ে বেশি ছিল বালি/এই বালির ভিতরে ধীরে-ধীরে জীবনের ফুলকে ফোটানো/কাজটা সহজ ছিল না মোটেও/তার জন্য শ্রম চাই, চাই নিষ্ঠা, চাই ভালোবাসা/চাই প্রয়োজনমতো জল-হাওয়া। রাগ-অনুরাগে হৃদয়ের সেই নিভৃত অনুভবের সন্ধানে বিশ্বকবির উচ্চারণটি এমন- সখী, ভাবনা কাহারে বলে/সখী, যাতনা কাহারে বলে/তোমরা যে বল দিবস-রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা-সখী, ভালোবাসা কারে কয়...। সুরের আশ্রয়ে এভাবেই মনের গহীনে আলোড়ন তোলা বিচিত্র এ অনুভবকে উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন অনেকেই। সেই সূত্রে গল্প-কবিতা-উপন্যাস কিংবা গানের বাণীতে অজস্রবার উচ্চারিত হয়েছে হৃদয়ঘটিত সে বোধের কথা। মঙ্গলবার শহরজুড়ে প্রকাশ্যে বা একান্তে প্রকাশিত হয়েছে প্রেমের সেই বার্তা। প্রেমিকযুগলরা নতুন করে বলেছে অনাদিকালের পুরনো সেই কথা ‘ভালোবাসি তোমায়’। অথবা কাব্যিক ঢংয়ে বলার ধরনটি ছিল এমন- ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে/সেই কথাটি তোমায় যাব বলে/ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে/পাখির গানে আকাশ গেল পুড়ে...। ঋতুরাজ বসন্তের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার ছিল ‘সেই’ কথাটি বলার। এদিন ছিল বিশ্ব ভালবাসা দিবস। ইতিহাসের পাতায় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে। রাজধানীর পথে পথে চোখে পড়েছে দিবসটি উদ্্যাপনের সুন্দরতম দৃশ্যকল্প। ভালবাসার সেই দৃশ্যকাব্যে দিনভর সজীবতা বিরাজ করে শহরে। এদিন দখিনা হাওয়ামাখা বসন্তে গুচ্ছ লাল গোলাপ যেন ঘুরে বেড়িয়েছে দ্রুতগামী এই নগরে। তবে এই গোলাপগুলো নিজেরা হেঁটে শহর পরিভ্রমণ করেনি। কোন ফুলচাষীর বাগান হয়ে পুষ্পবিতান ঘুরে প্রথমে উঠে এসেছে প্রেমের উদ্্যাপনে মশগুল প্রিয়তমদের হাতে। এরপর ভালবাসার নিবেদন হয়ে ঠাঁই পেয়েছে প্রিয়তমাদের হাতের মুঠোয়। ভালবাসা প্রকাশের সে ফুলগুলো বসন্ত বিলাসের স্মারক এঁকে লাল বসনা প্রেয়সীদের সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে নগরের পথে-প্রান্তে। যদিও দিনক্ষণ বেঁধে ভালবাসা হয় না। প্রকৃতির নিয়মে সহজাতভাবে হৃদয়ে জাগে ভালবাসা। তবে হৃদয়ের ভাষা প্রকাশের বিশেষ কোন দিন থাকলে ক্ষতি কি? নানা দিবসের মতো ওই দিনটিতে না হয় একটু বেশি উচ্চারিত হলো ভালবাসার কথা। অথবা বিশেষ দিবসের সুযোগে প্রকাশিত হলো প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমাকে মনের কথা জানান দেয়ার সুপ্ত বাসনাটি। দিবসটি আবাহনে প্রেমিক-প্রেমিকারা ভালবাসাবাসিতে পার করেছে সকাল থেকে রাত। ব্যক্ত হয়েছে বাকি জীবনে পাশে থাকার প্রত্যয়। প্রিয়জনের পাশাপাশি এদিন পরিবারের আপনজন বা প্রিয় বন্ধুটিকেও জানানো হয়েছে তার প্রতি মমত্ব বা মনের গভীরতম টানের কথাটি। ভালবাসা দিবসে রাজধানীর শাহবাগের পুষ্প বিতানগুলোয় ছিল প্রেমরসিক জমজমাট আনাগোনা। ফুলটি কিনে প্রিয়জনকে তুলে দিয়ে একে অপরকে জানিয়েছে ফুলের শুভেচ্ছা। বসন্তের দোলা লাগা ফাগুনের রং মাখা পোশাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের দেখা মিলেছে কপোত-কপোতীদের। অধিকাংশ মেয়েদের সাজসজ্জায় লালরঙা শাড়ির সঙ্গে খোপায় জুড়ে গেছে রকমারি ফুলের মালা। কারও বা মাথায় চড়ে বসেছিল ফুলে গড়া টায়রা। এমন বাহারি পোশাক আর বসন্ত বাতাসের ছোঁয়া লাগা উৎফুল্ল মননে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চারপাশের চওড়া সড়কের পাশে নিভৃতে গল্প করে কেটেছে অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকার সুন্দর সময়। দিনমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা রমনা পার্কে সুন্দর সময় কাটিয়েও ঘটেছে প্রেমের উদ্্যাপন। দুপুরের পর বিকেলে প্রেমিক যুগলদের অনেকেই ভিড় জমিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সেখানে ফুলের বদলে বইয়ের আশ্রয়ে হয়েছে ভালবাসার বিনিময়। বসন্তের মাতাল সমীরণে ভালবাসা দিবসে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল অনেক প্রেমিকযুগল। হৃদয়ঘটিত গভীর উচ্ছ্বাস ধারণ করে তারা চষে বেড়িয়েছে ঢাকা শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মাতাল করা বসন্ত বাতাসের শরীরে ভাসিয়েছে তাদের মন। অন্তর উজাড় করে বলা হয়েছে আগামী দিনের প্রেম পথে চলার কথা। এই সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের অন্তরের স্পন্দিত আবেগে উদ্্যাপিত হয়েছে ভালবাসা দিবস। দিনটি যে ছিল শুধুই ভালবাসার। ‘নিভৃতে যতনে মনের মন্দিরে’ প্রিয়জনকে আরাধনার একটি দিন। সম্পর্কের বন্ধনকে জোরালো করার এক অনন্য ক্ষণ। জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিকযুগল অনাবিল আনন্দে ঘুরে বেরিয়েছে রাজধানীর নানা আঙিনায়। যানজটের শহরে ক্রিং ক্রিং শব্দ তোলা তিন চাকার রিক্সায় চেপে কেউ বা কাটিয়েছে মধুর সময়। নির্ঝঞ্জাট রেস্তরাঁয় বসে আনন্দময় আহারের সঙ্গে চলেছে ভাব বিনিময়। নগরের বিভিন্ন কফি হাউস থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বসেও হয়েছে প্রেম বিনিময়। ভাললাগার মানুষের প্রতি মুগ্ধতার প্রকাশে বলা হয়েছে ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো’। পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে রেস্তরাঁয় বসে মজা করে খাওয়া, মনটাকে প্রসারিত করে উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো, শাহবাগ থেকে প্রিয়জনের হাতে ফুল কিংবা একুশে গ্রন্থমেলা বই তুলে দেয়া, মন জুড়ানো প্রেমের বাণীযুক্ত কার্ড উপহার দেয়া, সিনেমা দেখে লম্বা সময় কাটিয়ে দেয়াÑ এমন নানা অনুষঙ্গের ভেতর দিয়ে পরিলক্ষিত হয়েছে ভালবাসা দিবসে প্রেমের উত্তাপ। ভালবাসার কাছে যেন হারিয়ে যায় দূরত্ব। দীর্ঘ পথের ব্যবধানটাও যেন হৃদয় প্রবাহিত উত্তাপে হয়ে যায় খুব কাছের। এই দূরত্বকে হারিয়ে দেয়া এক প্রেমিকযুগলের দেখা মেলে ভালবাসা দিবসে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তন্ময় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইতির ভালবাসার প্রকাশ ঘুচিয়ে দিয়েছে সেই দূরত্বকে। খুব সকালে ইতির সঙ্গে দেখা করতে সাভার থেকে বাসে চেপে তন্ময় এসে পৌঁছান ঢাকায়। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে কথা হয় এই জুটির সঙ্গে। তন্ময় বলেন, এমনিতে তো সব সময় ভালবাসা থাকে। তবে এ জন্য বিশেষ দিবস থাকলে সেটার তাৎপর্যটা হয় ভিন্নরকম। তাই ভালবাসা দিবস উপলক্ষে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সাভার থেকে ছুটে এসেছি শাহবাগ প্রান্তে। দিনভর ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলে গ্রন্থমেলা ঘুরে ওর হাতে তুলে দেব পছন্দের কিছু বই। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া, একান্ত আলাপচারিতা ও ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় একজন আরেকজনের কাছ থেকে বিদায় নেব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর থেকে বাংলা একাডেমির বইমেলা পর্যন্ত প্রেমিক যুগলদের হাতে হাতে দেখা গেছে লাল গোলাপ। ভালবাসা দিবসকে ঘিরে বিকেলে বাড়তি জনসমাগম ঘটে ক্যাম্পাস এলাকায়। ক্যাম্পাসের আশপাশের রেস্তরাঁয়-ক্যাফেতে দিনভর ছিল প্রেমিক-প্রেমিকার আনাগোনা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা অনুষদই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানম-ি লেক, চন্দ্রিমা উদ্যান, রমনা বটমূলসহ নানা স্থানে যুগল তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। দেখা গেছে শহুরে নর-নারীর ভালবাসার দৃশ্যকাব্য। লাল গোলাপসহ সুগন্ধিময় নানান বর্ণ ও আকৃতির ফুল দিয়ে প্রিয়জনকে বলা হয়েছে হƒদয়ে চাপা থাকা অব্যক্ত কথাটি। এছাড়া ভালবাসা দিবসে কেবলই ফুল নয়, শুভেচ্ছা কার্ড, খুদে বার্তা, ফেসবুক কিংবা টুইটারের মাধ্যমেও ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন অনেকে। সাগরের সীমাহীনতার মতো আমার উদারতা/গভীর আমার প্রেম/যতই তোমাকে দেই ততই পেয়ে যাই আমি/দু’টোই অসীমÑউইলিয়াম শেক্সপিয়রের অমর সৃষ্টি রোমিও জুলিয়েটের এই বাণীটি প্রেমপিপাসুদের ধ্বনি-প্রতিধ্বনির মধ্য দিয়ে ভালবাসা দিবসের শেষ হলেও, ভালবাসা থাকবে অমলিন ও অমর রয়ে গেল সেই প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে শুধু প্রেমিকযুগলের বাইরেও স্নেহ মমতা ও বন্ধনে গড়া ভালবাসা ছড়িয়ে পড়কু প্রতিটি মানুষের মাঝে, প্রতিটি সম্পর্কে ভেতরে। সবশেষে বলা যায়, ভালবেসে সুখী হোক সকলে।
×