ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফুলের পাইকারি বাজার রমরমা, ২০ কোটি টাকার বিক্রির টার্গেট

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফুলের পাইকারি বাজার রমরমা, ২০ কোটি টাকার বিক্রির টার্গেট

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী!’ মানুষের জীবনে ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। কত সহস্র উপমায় বিশেষায়িত এই ফুল। কত শত কবি তার কবিতায় ফুলের গুণকীর্তন করেছেন। শুদ্ধতা, পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক, ভালোবাসার অর্ঘ্য, শ্রদ্ধা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপকরণ, প্রার্থনার নৈবদ্য হিসেবে ফুলের ব্যবহার আরো কত কী! ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। জগৎ জুড়ে ফুলের ব্যবহার বর্তমানে যেমন চলছে ভবিষ্যতেও চলবে। ফুলের চাহিদার কমতি নেই বিশ্বজুড়ে। পয়লা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে জমে উঠেছে ফুলের ব্যবসা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, এবার সারা দেশে পাইকারি পর্যায়ে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ পয়লা ফাল্গুন ও আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে ফুল ব্যবহার করি। এদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিটি কানা ভরে ওঠে বিভিন্ন রঙের ফুলে। ফুল ব্যবসায়ীদের কছে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটি ঈদের উৎসব হিসেবে বিবেচিত। তবে ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি এই দুদিনে ফুল বিক্রি অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছায়। এ সময়কে কেন্দ্র করে ফুল ব্যবসায়ীদেরও থাকে বিশেষ প্র¯তুতি। রাজধানীবাসী গত কয়েকবছর ধরে এ দুটি দিবসে ফুলের গুরুত্ব একটু বেশিই দিচ্ছেন। এ দুইদিন অধিকাংশ মানুষের কাছে থাকে ফুল। রাজধানী কেন্দ্রিক ফুলের বর্তমান বড় বাজার হিসেবে শাহবাগ ও আগারগাঁও ফুলের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারা রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট ও আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ফুলের পাইকারি মার্কেট থেকে ফুল কিনে থাকেন। বিশেষ করে শাহবাগের পাইকারি বাজারের ফুল রাজধানীসহ সারা দেশে যায়। প্রতিদিন এখানে বিকিকিনি হয় প্রায় ৪০ লাখ টাকার ফুল। উৎসবের এই দুদিন মোট হিসাব না করা হলেও বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রেতারা বলছেন, শাহবাগ ও আগারগাঁও ফুল বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শনিবার ভোর ৬টায় সরেজমিনে রাজধানীর আগারগাঁও ফুলের পাইকারি বাজারে ঢুকতেই সুঘ্রাণ এসে লাগল নাকে। এক পা দু পা করে পা ফেলে বাজারের ভেতরে ঢুকে ঘ্রাণের মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। কোন ফুলের কত বেশি সুবাস, তা পরিমাপ করা খুবই কঠিন। শুধু সুবাসই নয়, হরেক রঙের ফুলের দৃশ্য দেখে চোখে ধাঁ ধা লেগে যাওয়ার উপক্রম হবে হয়ত। সারি সারি ফুল। টিনের চালার নিচে বিক্রেতারা বসে আছেন। ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়। টিনের চালা থেকে ঝুলছে রজনীগন্ধা, হলুদ-কমলা-রক্ত গাঁদা ফুলের মালা। সারি বেঁধে স্তুপ করে রাখা ছোট-বড় গোলাপ। প্রতিদিন রাত ৩টার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গার ফুল ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ ফুলের ট্রাক নিয়ে পাইকারি বাজারের সামনে উপস্থিত হতে শুরু করেন। প্রতিদিন ২০-৩০ টন ফুল আসে আগারগাও ও শাহবাগ ফুলের বাজারে। একের পর এক ট্রাক থেকে ফুল নামানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ভোর রাতে। সকাল ১০টা পর্যšত চলে এই বাজারের কার্যক্রম। তবে বেশিরভাগ সময় সকাল ৮টার মধ্যেই খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ফুল বিক্রি করে ফেলেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি পাইকারি বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০০ ব্যবসায়ী দৈনন্দিন এ ফুল বিক্রি করেন। আগারগাঁও মার্কেটের ফুল ব্যবসায়ী রহমত আলী বলেন, ‘অনেক সময় পাইকারি বিক্রেতা ও কৃষকরা আমাদের কাছে ফুল পাঠিয়ে দেন। আমরা বিক্রি করে কমিশন রেখে তাদের টাকা পাঠিয়ে দেই অথবা তারা আসলে তাদের হাতে দেই। আবার অনেক কৃষক অগ্রিম টাকা নিয়েই ফুল চাষ করে সেখান থেকে ফুল পাঠিয়ে দেন।’ প্রতিদিন ২০-২৫ রকমের ফুলের আমদানি হয় পাইকারি বাজরগুলোতে। কেউ নিজ এলাকা থেকে ফুল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাইকারি দামে ফুল কিনে এনে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে আবার কেউ নিজ বাগানে চাষ করা ফুল এনে বিক্রি করেন। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, গরমকালে ফুলে আমদানিটা কমে যায়। ফুল নষ্ট হয়ে যায়। আর বরাবরই শতিকালে ফুলের প্রাচুর্য্যতা ও কদর দুটোই বেড়ে যায়।’ আব্দুল লতিফ বিশ্বাস প্রায় ১০ বছর ধরে ফুলের ব্যবসা করছেন। মেহেরপুর থেকে তাঁর ফুল আসে। নিজেরই ফুলের বাগান আছে। তার উদ্যোগেই চাষ হয় বাগানে। তিনি বললেন, ‘আমি কেবল গোলাপের চাষই করি। বেশিরভাগ সময় ওখান থেকেই ফুল পাঠাইয়ে দিই। আজকে আমিও আইছি। এই মাসের জন্যি আমরা ফুল ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করি থাকি।’ কোন ফুলের দাম সবচেয়ে বেশি জানতে চাইলে আফসার নামের এক পাইকারি বিক্রেতা বললেন, ‘কার্নিসান ফুলের দামই সবচেয়ে বেশি। গোলাপি, বেগুনী, লাল রঙের কার্নিসানের প্রতি আটির দাম ২০০০-২২৫০ টাকা। এছাড়া সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনী, কমলা রঙের গ্যালোডালাস প্রতি ১০০ পিছের দাম ৭০০-৮০০ টাকা। লাল, সাদা, বেগুনী, গোলাপী রঙের জারবারা ফুল প্রতি ২০টার দাম ৩০০-৩২০ টাকা। জারবারা ৫-১০ টাকা পিস। এই ফুলটির চাষ বাংলাদেশে হয়না বলে জানালেন এই বিক্রেতা। ভারত থেকে আমদানি হয় জারজাবা ফুল। অন্যান্য ফুলের মধ্যে গাঁদা ফুল এক ঝোপা (২০টি মালায় এক ঝোপা) বিক্রি হয় ১৫০-৩০০ টাকার মধ্যে। গোলাপ দুই ধরনের লিংকন ও ম্যারিন্ডা। প্রতি একশ লিংকন ১০০-১৫০ টাকা, আর ম্যারিন্ডা প্রতি একশ ২৫০-৩০০ টাকা। রজনীগন্ধা সিঙ্গেল একশ পড়বে ১০০-১৫০ টাকা। হাইব্রিড ২০০-৩০০ টাকা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন ফেব্রুয়ারি মাসের বাজার সম্পর্কে জনকণ্ঠকে বললেন, ‘এ মাসের উৎসবকে কেন্দ্র করে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছি। আরও বেশিও হতে পারে বলে আশা করছি। শূলত এ মাসটিকে কেন্দ্র করেই আমরা ফুল ব্যবসায়ীরা টিকে আছি। ফল ব্যবসায়ে লাভ অতি সামান্য হয়। এছাড়া গরমকালে তেমন ব্যবসা জমে ওঠে না।’ দেশের মোট কয়টি এলাকা থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন ফুল আমদানি হচ্ছে জানতে চাইলে ইমামুল হোসেন বললেন, ‘প্রায় ১৯টি জেলায় এখন ফুল চাষ হয়। এদের মধ্যে যশোর, ঝিনাইদহ ও সাভার থেকে ফুল আসে বেশি। সেইসঙ্গে লাউতলা, মেহেরপুর, কালিগঞ্জ, চট্রগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, চুয়াডাঙা, রংপুর, কুষ্টিয়া, ভারত থেকেও প্রতিদিন ফুলের আমদানি হচ্ছে। সরাসরি ঢাকার ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসেন এবং চাষিরাও নিজেদের ফুল নিয়ে এখানে আসেন। প্রতিদিন রাজধানীর পাইকারি দুইটি ফুলের বাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। মৌসুমগুলোতে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।’ তবে ফুল সংরক্ষণ ও পরিবহনে আধুনিক ব্যবস্থার অভাবে উৎপাদিত ফুলের প্রায় ২০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান ফুল ব্যবসায়ীরা। চাষিদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, ফুল সংরক্ষণ ও পরিবহনে আধুনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি ফুলের উন্নত জাত ও মান উন্নয়নে গবেষণা জোরদার করার আহ্বান সবার। অন্যদিকে, রাজধানীতে পাইকারি ফুলের কোন স্থায়ী বাজার নেই বলে আক্ষেপ ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘ঢাকায় ফুলের স্থায়ী কোনো বাজার নেই। শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে দুটি বাজার। আগারগাঁওয়ের এ বাজার আগে খামারবাড়িতে ছিল। আড়াই বছর আগে সেখান থেকে চলে আসে বাজারটি। শাহবাগ কিংবা আগারগাঁও পাইকারি ফুলের বাজার কোনটিই স্থায়ী না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌখিকভাবে অনুমতি দিয়েছেন। স্থায়ী জায়গা করে দিলে আমরা উপকৃত হতাম। ট্যাক্স, ভ্যাট সবই দিব, কিন্তু স্থায়ী জায়গা চাই বলে দাবি জানান তিনি। বর্তমানে দেশের উৎপাদিত ফুল দুবাই, কাতার ও কুয়েতে রফতানি হচ্ছে। ’
×