ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খাল ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযানের প্রস্তুতি এবার

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

খাল ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযানের প্রস্তুতি এবার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ খালপাড় ঘেষে সারি সারি স্থাপনা। কাঁচা পাকা দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়েছে খালের ওপর। রয়েছে আবাসিক ভবনও। বলতে গেলে ইচ্ছেমতো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে খালের বুকে। ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনীর গুদারাঘাটের এই চিত্রই বলে দেয় কতটা লাগামহীনভাবে চলছে খাল দখলের মহোৎসব। সরকারী জমি দখল করে অবাধে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পুরো খাল দখলে মরিয়া স্থানীয় ভূমিদস্যুরাও। এভাবেই দিনের পর দিন রাজধানীর খালগুলো সরু হয়ে রেখায় পরিণত হচ্ছে! ঢাকার প্রায় সবগুলো খালের চিত্র ঠিক এরকমই। নগর বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন, দূষণের কবল থেকে রাজধানীকে বাঁচাতে হলে খালগুলো উদ্ধারের বিকল্প নেই। সর্বশেষ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে খালগুলো উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র প্রার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে দখলে যাওয়া ৪৩টি খাল ও পুরনো ঢাকার আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউন উচ্ছেদ অভিযানে নামছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (্িডএসসিসি)। এরমধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে খাল উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। এক মার্চ থেকে কেমিক্যালের গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছেন মেয়র সাঈদ খোকন। চলতি মাসের ১৫ তারিখ থেকে রাজধানীর ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করার অভিযানে নামে সিটি কর্পোরেশন। অনেকদিন পরে হলেও এই অভিযানে সফলতা এসেছে। গত ১০দিনে পাল্টে গেছে গোটা মতিঝিলসহ পল্টন এলাকার চিত্র। এখন গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, ফকিরাপুল, ইত্তেফাক মোড়, দৈনিক বাংলা, স্টেডিয়াম এলাকা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিরো পয়েন্ট, ফুলবাড়িয়া থেকে শুরু করে আশপাশের গোটা এলাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। হকারমুক্ত সবখানেই। ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত রাখতে ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে চারটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। তাই এবার খাল উদ্ধার ও বিপজ্জনক কেমিক্যালের গোডাউন উচ্ছেদে অনড় সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশন সূত্রগুলো বলছে, ইতোমধ্যে উচ্ছেদ অভিযানে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোন খালে কবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে সে তালিকাও প্রস্তুত করা হচ্ছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বৈঠকও ইতোমধ্যে হয়েছে। এ অভিযানে স্বরাষ্ট্র, পানি সম্পদ, স্থানীয় সরকারসহ একাধিক মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করবে। অভিযানের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপস্থিত থাকার জন্য কর্পোরেশন থেকে চিঠি পাঠানো হবে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে মেয়র নিজেও উপস্থিত থাকবেন। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। থাকবেন পুলিশ সদস্যরা। প্রয়োজনে র‌্যাবও মোতায়েন করা হবে। খাল উচ্ছেদের পর সীমানা চিহ্নিত করা হবে। এরপর নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে। খালের দু’পাড়ে লাগানো হবে ফুলসহ নানা প্রজাতির গাছ। রাজধানীর ভেতরে থাকা কয়েকটি খালের ওপর রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। একাধিক খাল মুক্ত করে সহজ যোগাযোগের জন্য নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা করার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে। গত ২২ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, বক্স কালভার্ট অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য ঘোষণা দেন। প্রাথমিকভাবে আগামী ৬ এবং ৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। অভিযানে সফলতাও এসেছিল। কিন্তু দখলমুক্ত রাখার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। তাই সবগুলো খাল এখন ফের দখল হয়েছে। অনেক খাল অস্তিত্বশূন্য হচ্ছে। খালের সংখ্যা কত ॥ রাজধানীর খাল সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা বলছে নগরীতে খালের সংখ্যা ২৬টি। অন্যদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালের সংখ্যা ৫০। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ঢাকায় মোট খালের সংখ্যা ৪৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াসার হিসাবে ১২টি এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে ২৪টি খাল আংশিক প্রবহমান বলা হয়েছে। বাকি খালগুলোর বেশির ভাগ অবৈধ দখলে বিলুপ্ত, কিছু আবার আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে বিলুপ্তির পথে। এ অবস্থায় বিলুপ্তপ্রায় খাল পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায় সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি তৈরি করা ম্যাপটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। ওয়াসা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর ২৬টি খাল ঢাকা ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি সংস্কারের কাজ চলছে। রাজধানীর অবৈধ দখলে থাকা খাল উদ্ধার অভিযান শুরু হচ্ছে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নেতৃত্বে এ অভিযানে অংশ নেবে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা জেলা প্রশাসন। রবিবার বিকেলে ডিএসসিসি নগরভবন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর খালগুলো বেদখল হওয়ার কারণে বর্ষার মৌসুমে নগরীতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। প্রভাবশালীরা এসব খাল দখল করে রেখেছে। দখলদার যেই হোক, তাদের উৎখাত করা হবে। হোক না সে রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আমরা কাউকে ছাড় দেব না। তিনি জানান, আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে নগরবাসীর চলাচল নির্বিঘœ করতে হাজারীবাগের সিকদার মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কের দু’পাশের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ কাজ শুরু করা হবে। এ কাজে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সার্বিক সহযোগিতা দেবে ডিএসসিসি। এক প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসি মেয়র বলেন, নন্দীপাড়া ত্রিমোহনী খালের দখলদার উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে খাল উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হবে। এটা অব্যাহত থাকবে। আগামী বর্ষায় যাতে নগরীতে জলাবদ্ধতা না হয় সে লক্ষ্যে ত্বরিত গতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খাল দখল করে গড়ে ওঠা সব রাজনৈতিক কার্যালয়, মসজিদ বা ধর্মীয় উপাসনালয় উচ্ছেদ করা হবে। ধর্মীয় উপাসনালয় অপসারণ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ধর্মগুরুদের মতামত নেয়া হবে। নগর ভবনে আয়োজিত বৈঠকে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, রাজধানীর খালগুলো নানাভাবে দখল হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসা সরকারী ও দাতা সংস্থায় সহায়তায় এসব খালের টেকসই দখলমুক্ত করার কার্যক্রম শুরু করেছে। ডিএসসিসি মেয়রের এ উদ্যোগ খাল দখলমুক্তকরণ কার্যক্রমকে আরও বেগবান করবে। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা একসময় প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হতো। তখন নগরীতে ৬৫টি খাল ছিল। বর্তমানে প্রবহমান খালের সংখ্যা ২৬টি। এর মধ্যে ৭টি খাল পড়েছে ডিএসসিসি এলাকায়। বাকি খালগুলো পড়েছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ধোলাইখাল, নন্দীপাড়া খাল, ত্রিমোহনী খাল ও ডিএনডি বাঁধ বন্যা নিয়ন্ত্রণ খালে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করলে খালগুলো আবারও পূর্বের ন্যায় সচল হবে। তিনি আরও বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন খালের মালিকানা ব্যক্তির নামেও রেকর্ড হয়ে গেছে। এসব জটিলতাও নিরসন জরুরী হয়ে পড়েছে। এক মার্চ থেকে কেমিক্যালের গোডাউন অপসারণ ॥ আগামী ১ মার্চ থেকে পুরান ঢাকায় যেসব কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা রয়েছে তা স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। মেয়র বলেন, পুরান ঢাকার যেসব কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১ মার্চ থেকে এই এগুলো স্থানান্তরিত হবে। এই কাজে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। একই সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং র‌্যাব সার্বিক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করবে। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরীর সব সমস্যাসমূহকে ধাপে ধাপে সমাধান করা হবে এবং একটি বাস্তবমূখী প্রস্তাব প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়নে দুই সিটি কর্পোরেশন একসঙ্গে কাজ করবে। জনগণের ফুটপাথ জনগণকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, আমরা মতিঝিল, গুলিস্তান ও তার আশপাশের এলাকাগুলোকে ফুটপাথ মুক্ত করেছি। আগামীতে যাতে কোনভাবে হকাররা ফুটপাথে বসতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে এবং থাকবে। ২০১০ সালে নিমতলী এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউন থেকে সৃষ্ট অগ্নিকা-ে ১২৪ জন মারা যান। পুরান ঢাকার ১০ থানাতেই আছে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম। এসবগুলোই নিরাপত্তার ঝুঁকির দিক থেকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কমিটিগুলো পুরোপুরি কাজই শুরু করতে পারেনি।
×