ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও টিকে আছে শতাধিক কারখানা

বাকরখানি ॥ অমর প্রেমের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

বাকরখানি ॥ অমর প্রেমের কাহিনী

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেরানীগঞ্জ, ২০ জানুয়ারি ॥ কেরানীগঞ্জে শতাধিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে বাকরখানি। প্রতিদিন বিক্রিও হচ্ছে সব। ঢাকাবাসীর অনেক পুরনো নাস্তা এই বাকরখানি। মেহমানদারিতে এর স্থান প্রথম। তাছাড়া এই পিঠা তৈরির পেছনে রয়েছে একটি অমর প্রেমের কালজয়ী গল্প। বাকরখানি তৈরি হয় ময়দা, চিনি, ঘি, পনির ও পানির মিশ্রণে। বাকরখানি চার রকমের তৈরি হয়ে থাকে। প্রকারভেদে প্রতিকেজি বাকরখানি বিক্রি হয় ১০০ টাকা থেকে ১শ’ ৫০ টাকায়। ব্যবসায়ী আজাদ মিয়ার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বাপ-দাদায় এই ব্যবসা করেছে। আমিও ২০ বছর যাবত এই কাজ করছি। তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। তিনি আরও বলেন, সাধারণ বাকরখানি প্রতিকেজি ১শ’ টাকা। এটি তৈরি হয় শুধু পানি, ময়দা ও লবণ দ্বারা। ১শ’ ১০ টাকা কেজি বাকরখানি তৈরিতে আগের উপাদানের সঙ্গে চিনি অতিরিক্ত মেশানো হয়। ১শ’ ৩০ টাকা কেজির বাকরখানিতে দিতে হয় ঘি। আর পনির মিশিয়ে যে বাকরখানি তৈরি হয় তার মূল্য ১শ’ ৫০ টাকা। দামের সঙ্গে এর স্বাদও ভিন্ন হয়। এক বস্তা (৫০ কেজি) ময়দা খরিদ করি ১৮শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। এক কেজি ময়দা দিয়ে ৩৮ থেকে ৪০টি বাকরখানি তৈরি করা যায়। প্রতি পিস বাকরখানি বিক্রি হয় ২ টাকায়। কর্মচারীদের বেতন হয়ে থাকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। ৩/৪ মাস পরপর যখন চাহিদা একটু কম থাকে তখন গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। সাধারণত এই বাকরখানি তৈরি করে সিলেট জেলার লোকজন। আর এটি বেশি খায় ঢাকার লোকজন। বাকরখানি রুটি তৈরির পেছনে ঢাকায় কথিত রয়েছে যে, সে সময় ঢাকা ছিল পূর্ব বঙ্গের রাজধানী। ঢাকার কিছু নামীদামী পরিবারের সঙ্গে সিলেটের কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের সঙ্গে সৌহার্দ্য ভাব ছিল। সে সুবাদে তাদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। ঢাকা শহর যখন ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতি করতে থাকে, তখন সারাদেশের মতো সিলেটের লোকজনও ঢাকায় কাজের জন্য পাড়ি জমায়। অন্যান্য ব্যবসার চাইতে সহজ ও পুঁজি কম লাগে এ ব্যবসায়। যে কারণে বাখরখানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তারা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিলেটের লোকেরা বাকরখানি তৈরি করতে শিখেছে আফগানিস্তানের পাঠানদের থেকে। সিলেটে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে শেষ পাঠান বীর ওসমান খাঁ হেরে যান। ফলে কিছু পাঠান স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যায়। আর যারা মুঘলদের হাতে ধরা পড়ে তাদের দিয়ে রুটি তৈরি করানো হতো। এ বিষয়ে আরও কিংবদন্তি হয়েছে। বাকরখানি রুটির সঙ্গে একটি সুন্দর অমর প্রেম কাহিনী এবং নামকরণেরও একটি ঘটনা রয়েছে। সে সময় ঢাকার আরামবাগের খনি বেগমের নামে এক নর্তকী মহিলার সঙ্গে আগা বাকেরের গভীর প্রেম ছিল। কিংবদন্তি রয়েছে, সে সময় ঢাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন আগা সাদেকের পিতা আগা বাকের। তিনি মুর্শিদাবাদের মুর্শিদ কুলি খাঁর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত সভাসদ ছিলেন। অপর একটি তথ্যমতে, তিনি ছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁর প্রধান সিপাহসালার। তার সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগমের। ওই খনি বেগমের অপর এক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল উজিরেআলা জাহানদার খানের পুত্র কোতোয়াল জয়নুল খান। জয়নুল খান ১ দিন খনি বেগমের সহিত অসদাচরণের চেষ্টা করে। এ সময় আগা বাকের বাধা দেয় এবং উভয়ের মধ্যে খনি বেগমকে কেন্দ্র করে মল্লযুদ্ধ হয়। জয়নুল খাঁ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় গুজব ছড়ায় আগা বাকের জয়নুল খাঁকে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে জয়নুল খাঁর পিতা মুর্শিদ কুলি খানের কাছে বিচার প্রার্থনা করেন। মুর্শিদ কুলি খাঁ আগা বাকেরকে দোষী সাব্যস্ত করে বাঘের খাঁচায় তাকে বন্দী করেন। আগা বাকের বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বের হন। এর পর তিনি সংবাদ পান যে, তার প্রেয়সী খনি বেগমকে জয়নুল খাঁ অপহরণ করে বরিশালের চন্দ্রদ্বীপ এলাকায় নিয়ে গেছে। আগা বাকের তার সেনাপতি কালা গাজীকে সঙ্গে নিয়ে জয়নুল খাঁর পিছু ধাওয়া করে। অপরদিকে পুত্রের এই অপকীর্তির কথা শুনে তার পিতা ভাটি অঞ্চলের চন্দ্রদ্বীপ অবরোধ করেন। খনি বেগমকে বশে আনতে না পেরে জয়নুল খাঁ একটি বিষধর সাপ দিয়ে তাকে ভয় দেখায় যাতে সে বশে আসে। কিন্তু সে সাপই এক সময় জয়নুল খাঁকে দংশন করে। সে বিষের জ্বালায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার আশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভে বিষ মাখা ছুরি সে খনি বেগমের বুকে বসিয়ে দেয়। এ সময় আগা বাকের সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখেন, তার প্রেয়সী খনি বেগম বিষ যন্ত্রণায় ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। খনি বেগমের মৃত্যু আগা বাকেরকে বিষণœ করে তোলে। তার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন বরিশালে অবস্থানের পর আগা বাকের ঢাকায় চলে আসেন। কিংবদন্তি রয়েছে, আগা বাকেরের নামানুসারে ওই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে বাকেরগঞ্জ। ঢাকায় এসে প্রেয়সী খনি বেগমের স্মরণে নিজ হাতে এক ধরনের রুটি তৈরি করেন। নাম রাখেন বাকের খনি। ওই শব্দের কিছুটা পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয়েছে আজকের বাকরখানি।
×