ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

গ্রামীণ মানুষের সম্পদ বাড়ছে না, ঋণ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

গ্রামীণ মানুষের সম্পদ বাড়ছে না, ঋণ বাড়ছে

কৃষি, রফতানি ও রেমিটেন্স অর্থনীতির এই তিন স্তম্ভের মধ্যে প্রথম দুটোর অবস্থা ভাল। রেমিটেন্সের অবস্থা ততটা ভাল নয়। ২০১৬ সালের পুরো হিসেবে কৃষি খুবই ভাল করেছে। ভাল করেছে রফতানি খাতও। হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালে রফতানি বেড়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সালে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন সমান এক হাজার মিলিয়ন বা শত কোটি টাকা)। বিদেশের বাজারে পোশাকের ইউনিট পিছু মূল্য কিছুটা হ্রাস এবং পাউন্ডের মূল্য হ্রাস সত্ত্বেও রফতানি খাতের এই অগ্রগতি ভালই বলতে হবে। যদিও লক্ষ্যমাত্রা মাফিক রফতানির অবস্থা ভাল নয়। আমাদের রফতানির সিংহভাগ আসে পোশাক থেকে। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধারণা ২০১৭ সালে কোন সমস্যা হবে না। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি বহুজাতিক বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন তাহলে পোশাক রফতানি ব্যবসা লাভবান হতে পারে। কারণ, চুক্তি বাতিল করলে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভিয়েতনাম আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব এটা সুখবর হতে পারে। এছাড়া পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন নতুন বাজার খুলছে। জাপান, চীন ও ভারতে রফতানি বাড়ছে। ২০১৬ সালেই জাপানে পোশাক রফতানির পরিমাণ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ছিল। তবে এই খাতের নেতারা সমস্যার কথাও বলছেন। তাদের দরকার গ্যাস, বিদ্যুত। দরকার পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এইক্ষেত্রে বলা দরকার পণ্যের বহুমুখীকরণের মধ্যে শুধু পোশাকের বৈচিত্র্যকরণ নয়, বরং এর দ্বারা বোঝায় ব্যাপক বিষয়। রফতানির ৮০ ভাগই পোশাক। এর থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। পাকিস্তান আমলে ছিল পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া। এখন এসবের মূল্য কম। এখন রফতানি মানেই পোশাক। এক পণ্যের ভরসা কিন্তু কম, যেমন নেই এক ‘পোলার’ ভরসা। এক পণ্য অর্থাৎ তেলের রফতানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর অবস্থা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তেল রফতানিকারক দেশগুলো এখন বিদেশী শ্রমিক বিদায় করছে। কয়েকদিন আগে সৌদি আরবের একটি খবর ছাপা হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে এখন থেকে তারা দেশীয় শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করবে। কারণ আর্থিক মন্দা। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বারবার বলছেন এক পণ্যের নির্ভরশীলতা কমান। তিনি আরও বলছেন, শুধু রফতানি নয়, অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টি করুন। এসব কিন্তু কথার কথা নয়। দুনিয়া নতুন করে বদলে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন (গ্লোবালাইজেশন) ও অবাধ বাণিজ্য (ফ্রি ট্রেড) প্রশ্নের মুখে। ট্রাম্প এর গতিরোধ করে দিচ্ছেন। ‘ব্রেক্সিট’ (ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ) আরেকটি উদাহরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইংল্যান্ড এমন কতগুলো দেশে পোশাক রফতানি করে আমরা চিরকাল নিশ্চিত থাকব এমন সম্ভাবনা ধীরে ধীরে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ‘বল বল আপনা বল’ অর্থাৎ নিজস্ব ক্রয় ক্ষমতা, নিজস্ব বাজার, যে জিনিসটা হচ্ছে না। আমরা অনেক ক্ষেত্রে শুধু কথাই বলে যাচ্ছি। ফল বিচার করলে হতাশ হতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। ধরা যাক রেমিটেন্সের কথা। শুধু পরিমাণ নয়, এর ব্যবহারও। যে পরিমাণ রেমিটেন্স বাংলাদেশে প্রতিবছর আসছে তার সদ্ব্যবহার হলে গ্রামাঞ্চলের উন্নতি হতো অত্যন্ত প্রশংসনীয়। গ্রামের লোকের সম্পদ বাড়ত, উৎপাদনশীল খাত বড় হতো, ‘ভাইব্রেন্ট’ হতো। ব্যাংকিং সেবার উন্নতি হতো। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমরা শুধু বলছি রেমিটেন্সের পরিমাণ। এটাই আমাদের অহঙ্কার। অথচ সেই পরিমাণেই এখন চির ধরেছে। একে তো রফতানিতে আমরা এক পণ্যনির্ভর, দুইয়ে আমাদের রেমিটেন্সের পরিমাণ পাচ্ছে হ্রাস, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। কারণ, রেমিটেন্স দেশীয় ভোগকে উজ্জীবিত রাখে। ভোগের ওপর নির্ভরশীল জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার। সব তথ্য বলছে ২০১৬-১৭ সালে ভোগের পরিমাণ কমবে। কারণ, এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীর আয়ে টান পড়েছে, তাই রেমিটেন্সেও টান পড়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বনিম্ন ‘রেমিটেন্স’ এসেছে। ২০১২ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর ২০১৩ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে সেই রেমিটেন্স নেমে এসেছে ১৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। এটা একদিনে ঘটেনি। প্রতিমাসেই যে কমছে রেমিটেন্স তার খবর প্রতিদিন নিয়মিতভাবে দৈনিক জনকণ্ঠ দিয়েছে। রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, ডলারের মূল্য এবং কারেন্ট এ্যাকাউন্টের ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত অবস্থা। তার চেয়ে বড় কথা, দেশের বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ভোগের (কনসামশন) ওপর নির্ভরশীল। এক কথায় গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর করে ঐ রেমিটেন্সের ওপর। ঐ রেমিটেন্স মানে ‘ক্যাশ’। এই ‘ক্যাশ’ মানে এক-দেড় কোটি পরিবারের আয়। মাসের রেমিটেন্স দিয়ে বোঝা যায় না। তের-চৌদ্দ বিলিয়ন ডলার মানে কত টাকা? এক লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকা, আশি টাকা ডলার হিসাবে। এটা হচ্ছে সরকারী হিসাবে। এর বাইরে কত টাকার রেমিটেন্স ‘হুন্ডি’ মারফত আসে তার হিসাব কারও কাছে নেই। কেউ বলেন কমপক্ষে আরও ২০-৩০ শতাংশ রেমিটেন্স আসে ‘হুন্ডি’ মারফত। এখন ‘হুন্ডি’ তো খুবই সহজ ব্যাপার। ‘বিকাশ’ ব্যবস্থা ‘হুন্ডিকে’ ‘জলবৎ তরলং’ করে দিয়েছে। ভাবা যায় সব মিলিয়ে কত টাকা। এক-দেড় লাখ কোটি টাকা। এর একটা অংশ যদিও উৎপাদনশীল কাজে লাগত তাহলে গ্রামের অর্থনীতি থাকত সর্বদা উজ্জীবিত। গ্রামীণ মানুষের, গ্রামীণ পরিবারগুলোর সম্পদ বাড়ত, ঋণের পরিমাণ কমত। ব্যাংকের সেবার পরিধি বাড়ত। ‘এনজিও’ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্থাগুলোর দাপট কমত। কিন্তু তথ্যে দেখা যায় সব উল্টো ঘটছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে ভোগ-বিলাসের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। গ্রাম খারাপ দিক থেকে হতে চাইছে ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের ভাল দিক নয়, খারাপ দিকগুলো গ্রামাঞ্চল গ্রহণ করছে। গ্রামের বাজারে তকতক ঝকঝক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সোনার দোকান, ভোগ্যপণ্যের ছড়াছড়ি। একটু পরপরই বাগান বাড়ি। প্রতিযোগিতা করে লোকে কৃষি জমি নষ্ট করে বানাচ্ছে বাড়ি। অনেকে বিলাসবহুল বাড়ি বানাচ্ছে। সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, এমনকি কিশোরগঞ্জের মতো জেলাগুলোর উপজেলা শহরে গেলেও দেখা যাবে ইটালি, রোমের বাড়ির আদলে রেমিটেন্সপ্রাপকরা বাড়ি বানাচ্ছে। অপরদিকে অনেক পরিবারের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, সেই পরিমাণে বাড়ছে না সম্পদ। একটি কাগজে কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের কিছু তথ্য দেখলাম। অবিশ্বাস্য তথ্য। বলা হচ্ছে ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে গ্রামীণ পরিবারগুলোর মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ, অথচ সম্পদ যা ছিল তাই আছে। ২০০০ সালে মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৩৩৮ টাকা, সেইক্ষেত্রে ২০১৩ সালে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৭১ টাকা। গ্রামাঞ্চলে বাইরে থেকে রেমিটেন্স আসছে। শত শত ‘এনজিও’ ঋণ দিচ্ছে গ্রামীণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে। সরকার নানা কর্মসূচীর অধীনে গ্রামাঞ্চলে অর্থ সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। রয়েছে সরকারী ও বেসরকারী অনেক ব্যাংকের শাখা। এছাড়া সরকার প্রায় শত প্রকারের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের অধীনে গ্রামের মানুষকে সাহায্য করছে, অনুদান দিচ্ছে। এত টাকা যাচ্ছে কোথায়? যদি মানুষের ঋণ বাড়তেই থাকে, সম্পদ থাকে এক জায়গায় তাহলে তো একটা বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে হয়। সমগ্র জাতি কী ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠছে? এই প্রশ্ন করা এখন আর অবান্তর নয়। তার আগে ব্যাংক সম্পর্কে দুটো কথা। গত কয়েক বছর যাবত আমরা শুনলাম ‘ইনক্লুসিভ’ ব্যাংকিং-এর কথা অর্থাৎ সবার জন্য ব্যাংকের কথা। এর তো কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০০০ সালে গ্রামের লোক তাদের মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ নিত ব্যাংক থেকে। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে। বিপরীতে ৩২ শতাংশের স্থলে ৫০ শতাংশ ঋণ মানুষ এখন নেয় ‘এনজিও’গুলো থেকে। ২০১৬ সালের অবস্থা কী? এই তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে ধারণা করতে অসুবিধা নেই যে, পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়েছে। তাহলে আমরা যে ‘ইনক্লুসিভ’ ব্যাংকিং-এর কথা বললাম, তার কী হলো? বলাই বাহুল্য এসব সেøাগান। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গরিবের জন্য নয়, গ্রামীণ মানুষের জন্য নয়, নয় নতুন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার জন্য। ব্যাংকগুলো ক্রমেই ধনীদের ‘আড্ডাস্থল’ হয়ে উঠেছে। আইনে আছে এক ব্যক্তি, এক পরিবার দুই ব্যাংকের মালিক হতে পারবে না। কিন্তু চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে একই ব্যক্তি, গ্রুপ ৪-৫টি ব্যাংকের মালিক হয়ে পড়েছেন। ঋণ সুবিধা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে বড়জোর এক শ’-দুই শ’ লোকের মধ্যে। কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে কিছু অঞ্চলে। কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে ‘ব্যবসা’ খাতে। অথচ এগুলো পাকিস্তান আমলের ভূত। পাকিস্তান আমলের এমন ব্যাংকিং খাত দেখে আমরা বলেছিলাম জনগণের ব্যাংকের কথা, ব্যাংক যেতে শুরু করেছিল গ্রামে। এখন দেখা যাচ্ছে সব উল্টো। ‘এনজিও’ বড় হচ্ছে, ব্যাংক হচ্ছে ছোট। এর ফল, অন্যতম ফল হচ্ছেÑ সম্পদ বাড়ছে না, গ্রামীণ মানুষের বাড়ছে ঋণ। বাড়ছে তাদের ভোগবিলাস। ভোগবিলাসের অর্থনীতি পরিণামে আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে। জমি নষ্ট করে বাগানবাড়ি, জমি নষ্ট করে গহীন গ্রামে ‘আলিশান’ বিল্ডিং আমাদের কাম্য নয়। এমনিতেই কৃষির প্রবৃদ্ধি হ্রাসের দিকে। চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু মানুষের চাহিদা পরিবর্তনের কারণে আমাদের গম লাগে। গম আমাদের দেশে ততটা উৎপাদন হয় না। এমতাবস্থায় ভোগবিলাসী জীবনের জন্য কৃষি জমি নষ্ট করা আত্মঘাতী বিষয়। এটা বন্ধ হোক। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×