ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

২০১৭ সালের তথ্যপ্রযুক্তি এবং বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

২০১৭ সালের তথ্যপ্রযুক্তি এবং বাংলাদেশ!

বাংলাদেশের অনেক উন্নয়নকামী ক্ষেত্রের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি একটি। কয়েকটি বিশেষ কারণে এই বিষয়টি আলোচনায় থাকে, মিডিয়াতে থাকে এবং মানুষের মাথাতেও থাকে। সেই কারণগুলোর ভেতর থেকে যদি কয়েকটি বড় কারণ বের করে আনি তাহলে প্রথমেই বলতে হয় বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। আমাদের নারীরা যেমন পোশাক শিল্পে বিশাল একটি কাজের জায়গা পেয়েছে, তেমনি আমাদের বিশাল তরুণ প্রজন্মের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি হলো তেমন একটি খাত যেখানে লাখ লাখ মানুষ কাজ করতে পারে। আমি মনে করি, এর পাশাপাশি কৃষি হতে পারত বাংলাদেশের তরুণদের এরচেয়ে বড় খাত। আমাদের শিক্ষিত তরুণরা কৃষি নিয়ে মাতামাতি করছে এমনটা মিডিয়াতে চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশ কৃষিতে ভাল করছে- তার বড় একটি অংশই হলো গ্রামের সাধারণ মানুষ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কৃষির নতুন একটি পন্থা নিয়ে কাজ করছে, নতুন প্রজাতির ফল তৈরি করছে, খাবার বানাচ্ছে- এগুলো চোখে পড়ে না। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন নিয়ে অনেক মাতামাতি করে। সারাবিশ্বেই করে, আমরাও করি। তবে আমাদের অসংখ্য ছেলেমেয়ে ঘরে বসে বিদেশের কাজ করে এবং সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশের ব্যাংক-অফিস কিংবা ছোটখাটো সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে গড়ে উঠছে। আরেকটি বড় কারণ হলো, সরকার এটাকে জোর দিয়েছে। এই খাতে অনেক বাজেট দেয়া হচ্ছে এবং সত্যিকার অর্থেই চেষ্টা করছে এই খাতকে কাজে লাগিয়ে তরুণদের জন্য কিছু একটা করা যায় কি না। তাদের পদ্ধতি নিয়ে অনেক রকমের সমালোচনা থাকতে পারে। কাজ করলে সমালোচনা থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে তারা যে চেষ্টা করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তৃতীয় আরেকটি কারণ হলো মানুষের সহজাত আগ্রহ। কোন একটি বিষয়ে আগ্রহ থাকাটাও কিন্তু বিশাল একটি বিষয়। সরকার হয়ত এমন একটি বিষয়কে আমাদের মাঝে ঠেলে দিতে চাইছে, যেখানে মানুষের আগ্রহ নেই। সেই খাতকে বেশি দূর নেয়া যাবে না। কিন্তু মানুষের আগ্রহ আছে, সেখানে একটু ধাক্কা দিলেই বেশি ফল পাওয়া সম্ভব। এই তিনটি বিষয় যেহেতু আমাদের ভেতর আছে, তাই আমরা সব সময় এটা নিয়ে কিছু না কিছু দেখি, কথা বলি, আলোচনায় থাকি। রাজনীতির পাশাপাশি এটা বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য একটা ভাল টপিক বলা যেতে পারে। কিন্তু যে কারণে বছরের শুরুতেই এটা নিয়ে লিখছি, তা হয়ত আমাদের এই খাতের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে সাহায্য করবে। আমাদের সঠিক প্রত্যাশা নির্ধারণেও সহায়তা করবে। এই খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। এই একটি মাত্র খাত এত দ্রুত পাল্টে যায় যে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারাটা খুবই মুশকিল। ২০১৬ সালে যা ভেবেছেন এবং করেছেন ২০১৭ সালে দেখা যাবে একদম নতুন সব জিনিসপত্র এসে পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবন। চলুন একটু চোখ বুলিয়ে নেই, কী ধরনের প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে ছুঁয়ে যাবে ২০১৭ সালে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই বিষয়টি যে নতুন তা নয়। কয়েক দশক ধরে একটি কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে দাবা খেলায় জিতে গেলে সংবাদের শিরোনাম হতো। কিন্তু এখন সময় অনেক পাল্টে গেছে। এখন কম্পিউটিং ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারছি। মেশিন লার্নিং হলো আরেকটি প্রযুক্তি, যা আপনার ব্যবহার দেখে আপনাকে চিনে ফেলে। সে বলে দিতে পারে পরের ধাপে আপনি কী করবেন। সারা পৃথিবীতে মানুষ যে পরিমাণ তথ্য কনজিউম করে, মানুষ যেভাবে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে, তাতে কনটেন্ট ডেভেলপার এবং বিপণনকারীরা এর থেকে ব্যাপক সুবিধা পাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের চারপাশে এমনভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা আমরা আলাদা করে বুঝতেও পারব না। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে যেমন শুধু রোবটকে বুঝতাম, এখন সেগুলো আমাদের ঘরে প্রবেশ করেছে। আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) এটাও একটি নতুন দিক উন্মোচন। এই গ্রহের যাবতীয় ডিভাইস ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ব্যবহারকারীরা এখন আর পিসি, ল্যাপটপ এবং স্মার্টফোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যেমন, স্মার্ট রেফ্রিজারেটর এখন সরাসরি ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর তাই যারা কনটেন্ট তৈরি করেন তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এখন এমন কনটেন্ট তৈরি করা যা কিনা আইওটি প্ল্যাটফর্মে সকল ডিভাইসে কাজ করে। সঙ্গে আছে লোকেশনভিত্তিক কনটেন্ট, ডেটা মনিটর করা এবং ডিভাইসে রিয়েল টাইম এ্যালার্ট পাঠানো। এগুলো শুনতে একটু সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে। কিন্তু এই বিষয়গুলো এখন ঘটতে যাচ্ছে। আপনার বাসার ফ্রিজ যদি নিজে নিজে খাবার অর্ডার করতে পারে, সেটাকে আপনি গ্রহণ তো করবেনই। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি ২০১৬ সাল ছিল ভিআর এবং এআর এর বছর, যা কিনা ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্রামের চাইতে পোকেমন গো-কে জনপ্রিয় করেছে। আপনি ঘরে বসেই দোকানে কাপড় পরে সেটা কিনে ফেলতে পারছেন, আপনি ঘরে বসেই পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কারও সঙ্গে এমনভাবে ভাব বিনিময় করতে পারেন, যেমন আপনারা সামনাসামনি বসে আছেন। আজকাল ‘স্পর্শ’কেও ভার্চুয়াল করে ফেলার চেষ্টা মোটামুটি সফল হতে চলেছে। লাইভ স্ট্রিমিং লাইভ স্ট্রিমিং বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিচার। আর এই প্ল্যাটফর্মটিতে কনটেন্ট ডেভেলপাররা লাইভ কনটেন্টের চাহিদা মেটাবে। ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিমিং এমনভাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে যে, মানুষ যখন তখন লাইভ করছে। ফেসবুক ছাড়া আরও অনেক প্ল্যাটফর্ম আসতে শুরু করেছে, যেগুলো লাইভ স্ট্রিমিং করার সুবিধা দিচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসে লাগবে টিভিগুলোতে। মানুষ ওখানে লাইভ দেখত। কিন্তু মানুষ এখন ফেসবুকে লাইভ দেখে। এমনকি টিভি মিডিয়াগুলো নিজেদের অনুষ্ঠান ফেসবুকে লাইভ করছে। এ প্রযুক্তিটি মাত্র শুরু হলো। ২০১৭ সালে এর ব্যাপক প্রচলন হবে। ই-কমার্স এবং সোশ্যাল মিডিয়া বিগত কয়েক বছর ধরে ই-কমার্স এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের জীবনে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং পিন্টারেস্টের মতো সাইটগুলো কনটেন্টের জন্য বহুল ব্যবহৃত। পাশাপাশি এয়ারবিনবি, উবার, এমাজন ইত্যাদি সেবাতে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে মানুষ ইতোমধ্যেই উবারের সেবা পেতে শুরু করেছে এবং মানুষ এটাকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে। সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান যদিও এটাকে অনুমতির বেড়াজালে ফেলতে চাইছে; কিন্তু মানুষ যেখানে সুবিধা পাবে সেটা তো আর আটকে রাখা যাবে না। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিছু একটা করতে চায়। তবে ঠিক কী করতে চায়, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে কিছু একটা করতে চায়, সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। আমরা কখনও বাংলাদেশে সিলিকন ভ্যালি করতে চাই, লাখ লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করতে চাই, চাকরি আর করতেই চাই না, শুধু চাকরি দিতে চাই (তাহলে কার জন্য চাকরি দেব, কাকে দেব?), বিলিয়ন ডলারের রফতানি করতে চাই, গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনতে চাই ইত্যাদি হাজারো জিনিস করতে চাই। পুরো বিষয়টি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা কোন কিছুতেই ফোকাস না। অনেক তীর ছুড়ছি, যেটা গিয়ে লাগে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিতে এভাবে গুলি বা তীর লাগে না। আমরা যখন বলি বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রফতানি করব, এটা কিন্তু আজকে থেকে বলছি না, প্রায় ২০ বছর ধরে বলছি। এখনও বলে যাচ্ছি। এর কারণ হলো, এটাকে উপার্জন করতে হলে যেভাবে নামতে হয়, সেভাবে নামছি না। একটা সময়ে গিয়ে আমরা বিলিয়ন ডলার আয় করব ঠিকই; কিন্তু ততদিনে বাজার আরও অনেক বড় হয়ে যাবে। ২০০০ সালের বিলিয়ন ডালার আর ২০২০ সালের বিলিয়ন ডলার এক কথা নয়। আমি উপরের কিছু বর্তমান ট্রেন্ডের কথা বলেছি এই কারণে যে, পৃথিবী কোথায় চলে যাচ্ছে সেটা বোঝানোর জন্য। আমাদের সঙ্গে প্রযুক্তিগত দূরত্ব দিনকে দিন বাড়ছে। আমরা যদি আমাদের মানুষ দিয়ে মানুষের সমস্যা সমাধান করতে চাই, তাহলে এক ধরনের এ্যাপ্রোচ। আর আমরা যদি সিলিকন ভ্যালির মতো একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চাই, তাহলে আরেক ধরনের এ্যাপ্রোচ। এক সঙ্গে সবই কি করা সম্ভব? না। তাতে আপনি ফোকাস থাকবেন না। তখন আপনি কোনটাতেই ভাল করবেন না। সরকারের উচিত ২০১৭ সালে তারা দুটি বা তিনটি কাজ ভাল করে করবে, এটা ঠিক করে ফেলা। এর বাইরে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তখন বছর শেষে গিয়ে ভাল একটা ফল পাওয়া যাবে, যা ২০২১ সালকে সামনে রেখে করা হবে। আমরা যদি সত্যি এই খাতে ভাল ফল চাই, তাহলে এখনই যে বিষয়টি দরকার তা হলো ফোকাস, ফোকাস এবং ফোকাস! ৮ জানুয়ারি ২০১৭ ং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×