ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিভিল ব্যুরোক্রেসি চুক্তি বাস্তবায়ন চায় না- অভিযোগ জনসংহতির ;###;দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত সরকারের

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি আজ শুক্রবার

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি আজ শুক্রবার

নিখিল মানখিন ॥ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চলছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সরকার বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাহাত্তরটি ধারার মধ্যে আটচল্লিশটি ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। পনোরটির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। সরকারী উদ্যোগগুলোর মধ্যে পৃথক মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন কমিটি, কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন, আইন প্রণয়ন, কিছুসংখ্যক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ভারত প্রত্যাগত পরিবার এবং শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন এবং চলমান আলোচনা উল্লেখযোগ্য। জেএসএস বলছে, ৭২ ধারার মধ্যে মাত্র ২৫ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। এ দেশের সিভিল ব্যুরোক্রেসি পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন চায় না। ফলে নীতি নির্ধারকরা পদক্ষেপ নিতে পারে না। দীর্ঘ সময় গতিহীন থাকায় সরকারী উদ্যোগগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে পাহাড়ীরা। বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন মৌলিক অগ্রগতি হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি বর্তমান সরকারের আমলে একের পর এক কেবল প্রতিশ্রুতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। চুক্তিবাস্তবায়নে আর কালক্ষেপণ মেনে নেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে জেএসএস। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন হচ্ছে আজ শুক্রবার । শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে সরকার। সরকার পক্ষ বলছে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারাই ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির বাকি ধারা বাস্তবায়ন করতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের লোক সরকারী চাকরি পেতে পারে, এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিভিন্ন নীতি ও আইন শিথিল করা হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এডিবি, ড্যানিডা, ইইউ, সিডা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শান্তি ও উন্নয়নের পথ কখনই মসৃণ নয়। সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে গত ২৯ নবেম্বর রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত এক বিশাল গণসংবর্ধনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার উদ্দেশে বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য আন্দোলনের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন বলেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছে। এটা যেন কেউ ভুলে না যান। শান্তি চুক্তি আমরা করেছি। বিএনপি করেনি। চুক্তি যারা করেছে, বাস্তবায়নও করবে তারাই। অনেকে তো আছে, ‘মায়ের চেয়ে মাসির’ দরদ বেশি দেখায়। কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই করে না। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির শান্তির পায়রা উড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তাই পাহাড়ী বাঙালী সবার আপনজন তিনি। সন্তু লারমাকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, শেখ হাসিনার বার্তা নিয়ে খাগড়াছড়ির সেই দুর্গম দুদুকছড়িতে গিয়ে আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা করেছিলাম আমি। পার্বত্য শান্তিচুক্তি রাতারাতি হয়নি। এজন্য অনেক সাহসী ভূমিকা নিতে হয়েছে। তার আগের সরকারগুলো পাহাড়ে শান্তির নামে বারবার ধোঁকা দিয়ে প্রতারণা করেছিল। যা করেছে সব লোক দেখানো। তাদের আন্তরিকতা থাকলে অনেক আগে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতো। শেখ হাসিনার আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ছিল বলেই এই পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছেন। বুঝতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশী-বিদেশী অনেক চক্রান্ত আছে। এটাকে অশান্ত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় বিশেষ কুচক্রী গোষ্ঠী। তারা বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রাখতে নানা উস্কানি দিয়ে চলেছে। এসব উস্কানিকে আপনি প্রশ্রয় দিবেন না। প্রশ্রয় দিলে অশান্তি থাকবে। জনগণ কষ্ট পাবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর গত ১৯ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কি হয়েছে এবং তার আগে কি ছিল তা মিলিয়ে দেখার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ। তারা অভিযোগ করেন, সময়সূচী ভিত্তিক পরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণার মধ্য দিয়ে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে বর্তমান সরকারের কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষের প্রতি সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ বজায় আছে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যত কাজ করতে পারছে না? চুক্তি অনুযায়ী যে টাস্কফোর্স হয়েছে তাতে ভারত প্রত্যাগতদের কিছুটা পুনর্বাসন করা হলেও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। একজনকেও তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। তারা মানবেতর জীবন ধারণ করছে। টাস্কফোর্স কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে। তিনি পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার দাবি জানান এবং পাহাড়ের অনাকাক্সিক্ষত যেকোন ঘটনা এড়ানোর জন্য মিশ্র পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার আহ্বান জানান ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় । পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে অনেক কাজ করেছেন সাবেক তথ্য কমিশনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তির বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। চুক্তির বাস্তবায়ন সংখ্যা দিয়ে মাপা ঠিক নয়। ভূমি কমিশন কর্তৃক এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তির প্রাক্কালে তৃতীয় কোন পক্ষ ছিল না। দুই পক্ষের আলোকে চুক্তিটি হয়েছে এবং সেটি অব্যশই নিঃসন্দেহে সাহসিকতার পরিচয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা একাধিক প্রশাসন দেখতে পাই। যেটি মোটেই মঙ্গলজনক নয়।
×