ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া পরিবার জুম চাষ কমিয়ে ঝুঁকছে এই ফল চাষে

সবুজের পাহাড়ে ছোট ছোট গাছে থোকায় থোকায় কমলা, মাল্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২০ নভেম্বর ২০১৬

সবুজের পাহাড়ে ছোট ছোট গাছে থোকায় থোকায় কমলা, মাল্টা

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া/মোহাম্মদ আলী ॥ কমলা নামটি উচ্চারণ করলেই রসালো একটি সুস্বাদু ফল হিসেবে সকলের সামনে চলে আসে। বছরের পর বছর ভারত-বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এ কমলার চাষের ব্যাপ্তি ছিল। এক সময় রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকের কমলার নামও উঠে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনের পাশাপাশি এ কমলার চাষে ব্যাঘাত ঘটে। বিদেশ থেকে যে আমদানি শুরু হয় তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এখন সিলেটের কমলার নামের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমলা বাজারে মিলছে। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, দেশের সবুজ ও পাহাড়ঘেরা এক-দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় উৎপাদিত হচ্ছে সবুজ কমলা ও মাল্টা। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষ কমিয়ে এখন সবুজ কমলা ও হলুদাভ মাল্টা চাষের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। কৃষি বিভাগের গবেষকরা পাহাড়ে উৎপাদিত কমলার নাম দিয়েছেন অর্গানিক কমলা। এক সময় সিলেটের ছাতক ও রাঙ্গামাটির সাজেক ছিল কমলা চাষের স্থান। তবে সাজেকের কমলার চেয়ে সিলেটের কমলার খ্যাতি ছিল বেশি। পরবর্তী সময়ে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সাজেকের কমলাচাষীরা তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেললে এর উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় জুমিয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আবারও কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ করে। এর মধ্যে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় ৪০৫ একর, থানছি উপজেলায় ১৫০ একর, বাঘাইছড়ির সাজেকে ১৫০ একর, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ৩০০ একর, মাটিরাঙ্গায় ১৫০ একর ও রামগড়ে ১৫০ একর জমিতে কমলা চাষ শুরু হয় ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন পার্বত্য জেলায় আরও ৬০০ একর জমিতে কমলা চাষ শুরু হয়। এর মধ্যে বান্দরবানের চিম্বুকে ৬০ একর, মাজেরপাড়ায় ৭৫ একর, গুঙগুরু মুখে ৬০ একর ও তুনকংপাড়ায় ৬০ একর, রাঙ্গামাটির কাউখালীতে ১২০ একর, খাগড়াছড়ির বড়পাড়ায় ৬০ একর, সীমানাপাড়ায় ৬০ একর, আলুটিলায় ৯০ একর ও রবিধনপাড়ায় ৩০ একর জমিতে কমলা চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে কমলার পাশাপাশি অন্যান্য মিশ্র ফলের চাষও চলছে। বর্তমানে এ তিন জেলায় কমলার বাণিজ্যিক চাষ দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুম চাষের পরিবর্তে পাহাড়ীরা কমলাসহ মিশ্র ফল চাষের প্রতি ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কমলা আর মাল্টা চাষ করে পাহাড়ে বসবাসরত অনেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। পাহাড়ের সুস্বাদু কমলা আর মাল্টা বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি জেলায় এবার কমলার ব্যাপক ফলন হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার (হিমাগার) না থাকায় কমলাচাষীরা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ী-বাঙালীদের দারিদ্র্য বিমোচনে ৯৯ সালে ৬০০ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় কমলাসহ মিশ্র ফল চাষের সূত্রপাত ঘটায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এতে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা প্রদান করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। প্রকল্পটির নাম ছিল পার্বত্যাঞ্চলে প্রান্তিক চাষীদের কমলা ও মিশ্র ফল চাষ। এতে তিন পার্বত্য জেলায় যেসব পরিবার পুনর্বাসিত হয় তাদের প্রয়োজনীয় কমলা, কফি, পেঁপে, কলা ও আনারসের চারা বিতরণ করা হয়। কৃষি বিভাগের সূত্রমতে, বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইডেনপাড়া, মুন্নমপাড়া, বেথেলপাড়া, এথেলপাড়া, বগালেকপাড়া, কৈক্ষ্যংঝিড়ি, পাইন্দু, রনিনপাড়া, মুরংগপাড়া, শঙ্খমণিপাড়া, থানচি উপজেলার এ্যাম্পুপাড়া, কুনাংপাড়া, জিনিংঅংপাড়া, মঙ্গীপাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার বেতছড়া, গালেঙ্গ্যা, ঘেরাও, দোলিয়ামপাড়া, পোড়াপাড়া এবং জেলা সদরের স্যারনপাড়া ও লাইলুনপিপাড়া এলাকায় গড়ে উঠেছে সাড়ে তিন শতাধিক কমলা আর মাল্টা চাষের বাগান। চলতি বছর জেলায় প্রায় ৩৭০ হেক্টর জমিতে কমলা উৎপাদন হয়েছে। এদিকে, খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক এলাকার কমলাচাষী আলোপ্রিয় চাকমা জনকণ্ঠকে জানান, জুম চাষের পরিবর্তে পাহাড়ে কমলা আর মাল্টা চাষ বেড়েই চলেছে। কমলা চাষ করে তারা লাভবান হচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি কমলা চাষ করে আরও অনেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার কমলা আর মাল্টার ফলন ভাল হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় আর্থিকভাবে তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ফলে পাইকার ব্যবসায়ীদের কাছে এরা আগেভাগেই বাগান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অপরদিকে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পেরাছড়া এলাকার প্রাঞ্জল চাকমা জানান, ছোট গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ঝুলছে কমলা আর মাল্টা। গাঢ় সবুজ রঙের কমলা, মাল্টাগুলোর কোন কোনটিতে হলুদ রং এসেছে। প্রতিটি গাছে ৪০ থেকে ৫০টি ফল ধরে থাকে। আবার কোন কোন গাছে তারও বেশি। ৬০ হাজার করে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় দুটি কমলা বাগান বিক্রি করেছি। খাগড়াছড়ি বাজারের মিশ্র ফল ব্যবসায়ী এনাম উদ্দিন বলেন, রাঙ্গামাটির সাজেক ও পেরাছড়া এলাকার কমলা কিনে এনে বাজারে বিক্রি করি। কমলা ছোটগুলো জোড়া ২০ টাকা এবং বড় সাইজের জোড়া ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত কমলা আর মাল্টা খেতে সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও রয়েছে। বাজার ছেয়ে গেছে এখানকার কমলা আর মাল্টায়। যোগাযোগ করা হলে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এবার জেলায় কমলার ভাল ফলন হয়েছে। পাশাপাশি মাল্টার ফলনও খারাপ হয়নি। এ অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পরিকল্পিতভাবে সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কমলা আর মাল্টা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে বান্দরবানে। লাভজনক হওয়ায় জুম চাষের পরিবর্তে কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছে পাহাড়ীরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক তরুণ কুমার ভট্টাচার্য জানান, পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ী মাটি কমলা, মাল্টা চাষের উপযোগী। বাম্পার ফলনের পরও অগ্রিম বাগান কিনে নেয়ায় ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা রং আসার আগেই থোকায় থোকায় ছোট কমলা ছিঁড়ে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। কমলায় ১৬ নতুন জাত ॥ খাগড়াছড়ির পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা বারি-২ নামের কমলার নতুন জাত উদ্ভাবনের দাবি করেছেন। কেন্দ্রের ১৬টি গাছে এখন শোভা পাচ্ছে এ জাতের কমলা। নতুন এ জাত ইতোমধ্যে জাতীয় বীজ প্রত্যয়ন কেন্দ্রের স্বীকৃতিও পেয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, পাহাড়ী এলাকায় কমলার এ জাতের ফলন ভাল হবে। কেন্দ্রের গবেষকরা জানান, চীনা জাতের কমলার বীজ পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৮ সালে লাগানো হয়েছিল এই কেন্দ্রে। নির্বাচন (সিলেকশন) পদ্ধতির মাধ্যমে পাহাড়ে চাষের উপযোগী জাতটির উদ্ভাবন করেন তারা। খাগড়াছড়ি পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুর রউফ জানান, পার্বত্যাঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি বারি-২ কমলা চাষের উপযোগী। নতুন জাতটিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। তাই কৃষকরা চাষ করে লাভবান হতে পারবেন। নতুন জাতটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবদুর রউফ জানান, বীজের মাধ্যমে এবং কলম করে এ জাতের কমলার চারা উৎপাদন করা যায়। মাঝারি আকারের ফলটি মিষ্টির দিক থেকে চীনা কমলার প্রায় কাছাকাছি। পাকা কমলার মিষ্টত্ব ১৭ থেকে ১৮ টিএস। আর পাকা চীনা কমলার মিষ্টত্ব ১৮ থেকে ১৯ টিএস বলে জানান তিনি। খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ সুলতানা আফরোজ জানান, পার্বত্যাঞ্চলের কৃষকদের জন্য বারি-২ কমলার জাতটি বড় পাওয়া। এ জাতের কমলা অনেকের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। ইতোমধ্যে কৃষকদের মাঝে চারা বিতরণের কাজও চলছে। গবেষকরা জানান, কমলা চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ জরুরী। সাধারণত লাগানোর প্রথম তিন বছর কমলার ফলন তোলা ঠিক নয়। এ সময় ফুল ভেঙ্গে দিতে হয়। সঠিক পরিচর্যা করলে তিন বছর পর ভাল ফলন পাওয়া যায়। বান্দরবানের কমলা সম্পূর্ণভাবে সুমিষ্ট নয়, কিছুটা টক। তবে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত কমলার স্বাদ নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। এ কমলা সুমিষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। গত অক্টোবর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ রঙের কমলা ও হলুদাভ মাল্টা স্থানীয় পর্যায় ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হচ্ছে।
×