ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজওয়ানা আলী তনিমা

ইতিহাসের প্রভাবশালী পুরনারীরা

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৭ অক্টোবর ২০১৬

ইতিহাসের প্রভাবশালী পুরনারীরা

যুগে যুগে ইতিহাস রচিত হয়েছে পুরুষের শক্তিমান তরবারির তলে। তবে অন্তঃপুরে সবার চোখের অন্তরালে সেই তরবারির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতিহাসের গতিকে প্রভাবিত করে গেছেন অনেক নারী। এখানে এমনই কিছু প্রভাবশালী চরিত্রের কথা তুলে ধরা হলো। ১. জাহান আরা বেগম : জাহান আরা বেগম ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের কন্যা। সুদীর্ঘ ২৭ বছর মুঘল সংসারের ভার বহন করেছেন। তিনি ‘পাদিশাহ বেগম’ বা সার্বভৌম কর্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। যদিও সিংহাসনে লড়াইয়ে এই শাহজাদী ভাইদের মধ্যে দারাশিকোকে সমর্থন করেন। তবুও বিজয়ী আওরঙ্গজেব তাকে অসম্মান করেননি। বরং তাকে রাজদরবারে ফার্স্টলেডি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। রাজন্যদের ওপর তাকে তার বাসভবনে গিয়ে কুর্নিশও উপহার দেয়ার নিয়ম চালু হয়। ১৬৬৬ সালের ২৭ মার্চ রাজ্যাভিষেকের বার্ষিকীতে তাকে তৎকালীন এক লাখ স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেয়া হয় ও বার্ষিক ভাতা বাড়িয়ে সতেরো লাখ রুপী করা হয়। দিল্লীতে দেয়া হয় প্রাসাদ। সম্রাট তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, জাহান আরা প্রয়োজনবোধে পরাক্রমশালী ভাই আওরঙ্গজেবকে উপদেশ দান, এমনকি তিরস্কার পর্যন্ত করতেন। বাদশাহের ওপর এতটা ক্ষমতা আর কারোর ছিল না। পিতা শাহজাহানের মতো তারও স্থাপত্যে বিশেষ রুচি ছিল। তাঁর নির্দেশে নগর আর দুর্গের মাঝামাঝি অনুপম সরাই তৈরি হয় যার আদলে পরে ‘কুইনস গার্ডেন’ গড়ে ওঠে। ২. রওশন আরা বেগম : রওশন আরা বেগম, সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় কন্যা ও জাহান আরার বোন। সিংহাসনের লড়াইয়ে তিনি বোনের মতো ভাই দারশিকোকে না বরং আওরঙ্গজেবকে সক্রিয় সমর্থন দেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের নিপুণ কারিগর এই শাহজাদী হারেম থেকে ভাইকে নিয়মিত দরকারি তথ্য পাচার করতেন। এভাবে অনেক পদস্থ কর্মকর্তাদের সমর্থনও আদায় করেন তিনি। আওরঙ্গজেবের সফল সিংহাসন লাভের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল রওশন আরার। বিনিময়ে রাজ্যাভিষেকের দিন আওরঙ্গজেব তাকে পাঁচ লাখ রুপী উপহার দেন। ধীরে ধীরে রওশন আরা প্রভাব বিস্তার করে সম্রাটের অন্দরমহলকেও কব্জা করে ফেলেন। অপর বোন জাহান আরা বেগম পদ পাবার আগ পর্যন্ত তার এ প্রভাব অক্ষুণœ ছিল। রওশন আরা ছিলেন দানশীলা ও বুদ্ধিমতী। কিন্তু একপর্যায়ে যখন সম্রাট অসুস্থাবস্থায় তখন তিনি তার রাজকীয় ও ব্যক্তিগত সিলমোহর এবং ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন। এসব করে তিনি মুঘল শাহজাদা আজমকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরে বাদশাহ রওশন আরার ওপর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন ও তার সুবিধাগুলো খর্ব করেন। রওশন আরার বিরুদ্ধে নানা অপকীর্তির অভিযোগও ওঠে। এসবে সম্রাটের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে এমন অবস্থায় যায় যে ভাগ্যের পরিহাসে যে ভাইকে তিনি সিংহাসনে বসতে সাহায্য করেছিলেন তিনিই তাকে সেøা পয়জনিংয়ে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। এরই প্রভাবে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মারা যান রওশন আরা। ৩. নূরজাহান : মুঘল শাসনে সম্রাজ্যের ফার্স্টলেডি সম্রাজ্ঞী হতেন না, এই জায়গাটি বরাদ্দ থাকত রাজমাতার বা রাজবোনের জন্য। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন নূরজাহান। উচ্চাকাক্সক্ষী নূরজাহান নিজের রূপ, ব্যক্তিত্ব ও কৌশলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুলতানা হন। তাকে সারা হিন্দুস্তানের সম্রাজ্ঞীর সম্মান দেয়া হয়। তার নাম সম্রাটের নামের সঙ্গে যুক্ত করে মুদ্রা চালু হয়। এমনকি তার সঙ্গে আলোচনা না করে সম্রাট কোন সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। রাজতখতের যুদ্ধে আরও অনেক পুরনারীর মতো তিনিও যুক্ত হয়ে পড়েন। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি সম্রাটের সৈন্যদলকে সরাসরি নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছেন। হাতির পিঠে চড়ে নদী পার হয়েছেন, তীর-ধনুক দিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। তারই সেনাদল সফলভাবে রুদ্ধ জাহাঙ্গীরকে শত্রুর কাছ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। তার সাহসিকতার অনুপম পরিচয় পাওয়া যায় যখন একদা গুপ্তঘাতক তাকে হত্যা করতে এলে তিনি অকম্পিত গলায় তাকে বলেন যে নূরজাহান মরতে ভয় পায় না। ঘাতক তার ভুবনজয়ী রূপ ও ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াও বিখ্যাত দামী গোলাপের সুগন্ধী ‘ইথ-ই-জাহাঙ্গীর’ ও তার আবিষ্কার। পরে তিনি সাধারণের জন্য অল্পমূল্যের সুগন্ধীও তৈরি করেন। মুঘল স্থাপত্যে নূরজাহান তার সুরুচির পরিচয় রেখে গেছেন তার তৈরি করা সরাই, বাগান ও বাড়ির মধ্যে। নূরজাহান একজন সুদক্ষ ফ্যাশন ডিজাইনার, গহনা ডিজাইনকারী ও অন্দরসজ্জাকারিণীও ছিলেন। তার তৈরি করা পোশাকের ডিজাইন রীতিমতো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে ও জনপ্রিয় হয়। ৪. ঘষেটি বেগম : তালিকার চার নম্বর নামটি হলো ইতিহাস কুখ্যাত ঘষেটি বেগমের। ইনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ্্-দৌলার খালা। সিরাজের ভাই ইকরাম-উদ্্-দৌলা এরই দত্তক পুত্র। নবাব আলিবর্দী খানের মনোনীত উত্তরাধিকারী সিরাজের বদলে তিনি তার এই পুত্রকে সিংহাসনে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে তিনি ইকরামের নাবালক পুত্রকে মসনদে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। নানা কারণে তার খালার সঙ্গে নবাব সিরাজের অনেক আগে থেকেই বিরোধ। দুজনই ছিলেন বেশ উচ্চাকাক্সক্ষী। আবার সিরাজ ইতিহাসের বীর হিসেবে পরিচিত হলেও শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাচারী ও মানুষ হিসেবে নিষ্ঠুর। তার বিরুদ্ধে রাজ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নবাব কর্তৃক কারাগাররুদ্ধ স্বার্থপর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ ঘষেটি বেগম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চক্রান্ত শুরু করেন। বস্তুত নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মূল গঠনমূলক ভূমিকাই ঘষেটি বেগমের। নবাব শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন ঠিকই কিন্তু ক্ষমতা তিনি পাননি। এক সময় তার পিতা ওস্বামী উপকারধন্য মীর জাফরের ছেলে মিরুনি তাকে গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে হত্যা করে। ৫. বেগম সামরু : বেগম সামরু কোন নবাবের অন্তঃপুরিকা ছিলেন না, ছিলেন সম্রাটের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর জেনারেল সামরুর হারেমের নারী। নিজগুণে সামান্য একজন উপপত্নী কাতার থেকে উঠে এসে এই সন্তানহীনা ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন। ১৭৭৮ সালে জেনারেল সামরু মারা যাওয়ার পরে তার ইউরোপিয়ান ও স্থানীয় অধিনায়কেরা বেগম সামরুকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বভার নেয়ার অনুরোধ করে। তৎকালীন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মতিতে তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে তার মর্যাদা হয়ে পড়ে একজন শাহজাদীর মতো। বেগম সামরুর তার সামরিক যোদ্ধা স্বামীর সঙ্গে থেকে থেকে অভিযানে অংশ নেয়ায় সমর কৌশলে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি দরকার মতো তাকে রীতিমতো উপদেশ-পরামর্শও দিতেন। বেগমের সুযোগ্য নেতৃত্বে অধীনস্থ দল দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। একবার সম্রাট শাহ আলমের গোকুলগড়ের বিদ্রোহী রাজাকে দমন করতে অগ্রসর হন। সেকালে এমন বিদ্রোহ ছিল নিয়মিত। বেগম সামরু সৈন্যদলসহ এই যুদ্ধে সম্রাটের সাহায্যকারিণী ছিলেন। রাজার সৈন্যদল আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করলে বীরদর্পে একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে চলে আসেন। তার সরাসরি নেতৃত্ব ও সাহস যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সম্রাট বেঁচে যান। এই ঘটনার পরে সম্রাট তাকে তার সবচেয়ে প্রিয় কন্যা সম্বোধনে সম্মানিত করেন। বেগম সামরু যোদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ কূটনীতিকও ছিলেন। তার প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ছিল। তাই ধূর্ততার সঙ্গে অস্তগামী মুঘলের পরে উদীয়মান শক্তি ইংরেজের সঙ্গেও বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলতে পেরেছিলেন। তার দানশীলতাও ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে। সূত্র : প্রিন্সেস, বেগমস এ্যান্ড কনকিউবাইনস (বিপি সাহা, অনুবাদ : অনীশ দাস অপু)
×