ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিকলবন্দী জীবন রঙিলার

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

শিকলবন্দী জীবন রঙিলার

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ২৫ সেপ্টেম্বর ॥ নাম তার রঙিলা। বয়স ৩৯। কিন্তু নামের মতো রঙিন জীবন হয়নি তার। বরং তার অপ্রতিরোধ্য সঙ্কটময় বিবর্ণ জীবন একটু একটু করে গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভুল সিদ্ধান্তে হাতুড়ে কবিরাজের অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এখন তাকে পশুর মতো শিকলবন্দী জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তিনি জানেন না, কেন তাকে লোহার শিকলে বেঁধে রাখা হয়। কেবলই দিনরাত চলে তার শিকল ছেড়ার আপ্রাণ চেষ্টা। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের মৃত বিপেন চন্দ্র রায়ের পুত্র এই রঙিলা রায়। এক সময় চায়ের দোকানে কাজ করতেন। ভিটেমাটি বলতে দেড় শতক জমি। সেখানেই একটি টিনের ঘর তুলে স্ত্রী, দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বাস করতেন। ভালই চলছিল রঙিলার সংসার। এক মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন। হঠাৎ গত ২০১৩ সালের শেষের দিকে রঙিলার কথাবার্তা ও চলাফেরায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা ও জীবনাচরণে ক্ষাণিকটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে স্ত্রী পুষ্প রানী ঘাবড়ে যান। তিনি পরামর্শ চান আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীর কাছে। সবাই রায় দেয় রঙিলাকে ভূতে ধরেছে। পুষ্প রানী বলেন, ‘স্বামীকে সুস্থ করতে সবার পরামর্শে স্থানীয় বিভিন্ন ঠাকুর, কবিরাজ ও ফকিরের কাছে যাই। চিকিৎসার নামে তারা নানাভাবে শুধু টাকা নেয়ার ফন্দি আঁটে। চিকিৎসার অংশ হিসেবে আমার স্বামীকে নানা প্রকার ওষুধ খাওয়ায়, আর বিভিন্ন নির্মম শাস্তি দেয়। আর বলে এ শাস্তি আপনার স্বামী পাচ্ছে না। এ শাস্তি পাচ্ছে তার উপর যে ভূত ভর করেছে সে। এভাবে কবিরাজে অপচিকিৎসা নেয়ার কারণে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। তিনি বলেন, কবিরাজি চিকিৎসা শুরুর পর থেকে রঙিলার অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সব সময় চেচামেচি করে, বাড়িতে জিনিসপত্র ভাংচুর করতে থাকে। গ্রামের ছোট ছেলে মেয়েদের মারধর করে। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ অবস্থা চলছে প্রায় এক বছর ধরে। দিনের বেলা তাকে শিকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে বাড়ির পাশে কদমগাছের তলায় ও রাতে বাড়ির বারান্দায়। শুক্রবার সরজমিনে তারাগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের রঙিলার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাড়ির পাশের একটি কদমগাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় আছেন। তাকে দেখতে এলাকার ছোটবড় অনেকেই প্রতিনিয়তই ভিড় করে তার বাড়িতে। তিনি কোন লোক দেখলেই ডেকে বলেন, ‘ভাই, মোক ছাড়ি দেও। শিকলটা খুলি দেও। কবিরাজ আইলে মোক মাইরবে। ভাই, মোক একটা বিড়ি দেও? মোর জন্যে বিড়ি আনছিস। টাপাস করি বিড়ি দেও, মুই খাইম।’ স্ত্রী পুষ্প জানায়, আমাদের যে টুকু টাকা ছিল তা কবিরাজের পেছনে খরচ করেছি। এখন তো খেতেই পারি না, ডাক্তারের চিকিৎসা করতে টাকা পাব কোথায়? টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। কবিরাজের কাছে গিয়েই আজ আমার স্বামীর এই দশা বলেই কাঁদতে থাকেন রঙিলার স্ত্রী। মায়ের কান্না দেখে মেয়ে কণাও কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার বাবা হয় তো কোন দিনই ভাল হবে না। ডাক্তার বলেছে উন্নত চিকিৎসা করালে তিনি ভাল হবেন। কিন্তু আমরা টাকা পাব কোথায় ? এ বিষয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আফরোজা বেগম জানান, রঙিলার ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি সরজমিনে গিয়ে খরব নেব।
×